তিনি যেন নিজেই একটা দেশ। তাঁর অনুগামীরা শুধু কোনও দল বা ক্লাবের নয়। বরং আস্ত একটা দেশেরই নাগরিক, যে দেশের নাম ‘মেসি’। তিনি ফুটবলের ঈশ্বর। সবুজ মাঠে তিনিই লিখতে পারেন রূপকথা। আবার তিনিই দেখিয়েছেন, কাঁটার মুকুট মাথায় তুলে একজন মানুষ কতখানি ক্ষতবিক্ষত হতে পারেন। লিওনেল মেসি। সর্বকালের সেরা হয়েও, দেশের হয়ে ব্যর্থ – এতদিন এই কলঙ্কই ছিল শিরোধার্য। অবশেষে শাপমোচন। একুশের কোপা শেষে ফুটবলবিশ্বে ফুটল মেসি-রঙের ভোর।
চোদ্দটা বছর। ঠিক এতগুলো বছর পেরিয়েই রামচন্দ্র ফিরেছিলেন বনবাস থেকে। মেসিও ফিরলেন। ফিরলেন অপবাদের অরণ্য থেকে। সবুজ গালিচায় ফুটবল পায়ে যিনি ফুল ফোটান, তিনিই নাকি দেশের জার্সি গায়ে চরম ব্যর্থ। তিনি ক্লাবের হয়ে সফল, দেশের হয়ে নয়। এ যেন চাঁদের গায়ে লেগে থাকা কলঙ্ক! তাঁর হাতের ট্যাটুর মতোই এই অপবাদ যেন জুড়ে গিয়েছিল তাঁর নামের সঙ্গেও। অবশেষে শাপমুক্তি। শেষমেশ বনবাস কাটিয়ে ফিরে আসা নিজস্ব রাজপাটে। দেশের হয়ে ট্রফি খরা কাটল লিওনেল মেসির। কোপার ট্রফিতে এঁকে দিলেন সাফল্যের চুম্বন।
২৮ বছর পর কোপা জিতল আর্জেন্টিনা। আর সঙ্গে সঙ্গে যেন গোটা বিশ্বে জিতে গেল অসংখ্য ফুটবলপ্রেমী। না, তাঁরা সবাই আর্জেন্টিনার সমর্থক নন। তাঁরা যে সকলেই বার্সাকে ভালোবাসতেন, এমনও নয়। তাঁরা ভালোবাসেন মেসি নামে এক মহাজাগতিক প্রতিভাকে, যিনি সম্ভব করে তুলতে পারেন সব অসম্ভব। প্রতিদিন বিশ্বে প্রতি কোনায় হেরে যাওয়া মানুষের কানে কানে গিয়ে যিনি বলে আসতে পারতেন, এ পৃথিবীতে সত্যি হয় রূপকথা। তাই ভেঙে পড়তে নেই।
আরও শুনুন : শুধু ধোনি-কোহলি! কেন মিতালী বা ঝুলন হওয়ার স্বপ্ন নেই ক্রিকেটবিশ্বে?
তবু তিনি নিজেও কি ভেঙে পড়েননি! মহাভারতে ধর্মপুত্রের জন্যও তোলা ছিল নরকদর্শনের অভিজ্ঞতা। মেসির জন্যও তোলা ছিল দেশের হয়ে ট্রফি-খরা সহ্য করার অভিশপ্ত প্রায় দেড় দশক। একরকম নরকদর্শনই। পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৭ সালে কোপা ফাইনালে এই ব্রাজিলেরই মুখোমুখি হয়েছিল মেসির আর্জেন্টিনা। এসেছিল পরাজয়। তারপর ২০১৪-এর বিশ্বকাপেও তীরে এসে ডুবেছিল তরী। ২০১৫-এর কোপা ফাইনালেও চিলির কাছে সেই হার মানতে হয়েছিল মেসিকে। ২০১৬-র কোপা ফাইনালে নিজে পেনাল্টি মিস করে মাঠেই কেঁদে ফেলেছিলেন মেসি। পরাজয়ের ধারাবাহিকতা বজায় থেকেছিল।
প্রতিবার নীল-সাদা জার্সি পরে কত স্বপ্ন নিয়ে না তিনি নিজে মাঠে নেমেছেন। কত স্বপ্ন দেখিয়েছেন তাঁর অনুগামীদের। এমনকী তাঁর দেশের সমর্থক না হয়েও শুধু তাঁর খেলা দেখবেন বলেই উন্মুখ হয়ে থেকেছেন কত না বিপক্ষ দলের অনুগামী। কিন্তু যাঁকে মর্ত্যবাসী ফুটবলের ঈশ্বর হিসেবেই পুজো করেন, তাঁর জন্যও বিরূপ থাকেন অন্তর্যামী। বিশ্ব ফুটবল যে সোনার পা দুখানি পেয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে, তাঁর জন্য কেন যে এত ব্যর্থতা তোলা আছে, ভেবে বিমর্ষ হয়েছেন এই পৃথিবীর প্রায় সকল ফুটবলপ্রেমী। এই সেদিন চলে গেলেন মারাদোনা। বিশ্ব ফুটবল নিঃস্ব হল। আর, আর্জেন্টিনার সমর্থকরা যেন আরও ভেঙে পড়লেন। প্রিয় মারাদোনা তাঁদের কী না দিয়েছেন! তিনিই তো তাঁদের জন্য ছিনিয়ে এনে দিয়েছেন বিশ্ব ফুটবলের কুলীন সম্মান। অথচ তাঁকে দেওয়া হল না কিছুই। না আর কোনও বিশ্বকাপ, না কোপা! মেসিও এতদিন দিতে পারেননি তা।
দেখতে দেখতে গোধূলি নেমে এসেছে। কেরিয়ারের প্রান্তে চলে এসেছেন মেসি। একবার তো অবসর ঘোষণা করে ফেলেছিলেন। তাও এই কোপা হেরেই। সে সব পেরিয়ে এবারেরটাই হয়তো ছিল তাঁর শেষ কোপা। বিশ্বকাপের সময় আরও একটু বয়স্ক হয়ে যাবেন মেসি। অগণন ফুটবলপ্রেমীর মনে তাই ঘুরছিল একটাই প্রশ্ন, মেসিকে কি এবারও ফিরিয়ে দেবেন ঈশ্বর? বিশ্ব ফুটবলের সবথেকে বর্ণময় তবু বেরঙিন চরিত্র হয়েই থেকে যাবেন মেসি! একুশের কোপা দেখাল, যিনি দহন সইতে পারেন, ঈশ্বর তাঁকে ফেরান না। মেসি গোল করেননি ঠিকই, বরং সহজ গোল মিস করেছেন। কিন্তু তাঁর জন্য লেখা ছিল অন্য চিত্রনাট্য। তাঁর সাফল্যের মুকুটে পালক জুড়তে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলের জালে বল জড়ালেন বন্ধু ডি মারিয়া। হয়তো সেই মুহূর্তেই স্বর্গের উদ্যান থেকে দুহাত তুলে মেসিদের আশীর্বাদ করছিলেন সেই মানুষটি, যাঁর নাম দিয়েগো মারাদোনা।
আরও পড়ুন : কোন মন্ত্রে আজও দ্রাবিড় Mr. Dependable!
খেলা শেষের বাঁশি বাজতেই চোখে জল মেসির। সতীর্থরা তাঁকে ভরিয়ে দিলেন আদরে, উষ্ণতায়, আনন্দশ্রুতে। খাতায় কলমে, কোপার ফাইনালে ব্রাজিলকে হারিয়ে জিতে গেল আর্জেন্টিনা। কিন্তু আসলে তো জিতে গেল ফুটবল। তাই আর্জেন্টিনা জেতার পাশাপাশিই, সত্যি সত্যি জিতেছেন সেইসব ফুটবলপ্রেমীরা, যাঁরা ভালোবাসেন শিল্পিত ফুটবলকে। আগ্রাসনের সৌন্দর্য নয়, যাঁরা বুক পেতে জায়গা করে দেন সৌন্দর্যের আগ্রাসনকে। মেসি শুধু নিজে জেতেননি, জিতিয়ে দিয়েছেন তাঁদেরও। দেখিয়ে দিয়েছেন, জীবনে কেমন থাকে চড়াই-উতরাই। তবু যিনি নীরবে সহ্য করতে পারেন অগ্নিপরীক্ষা, সাফল্যের বরমাল্য তোলা থাকে তাঁরই জন্য। এটুকুই সত্যি। মেসির কোপা জয়ের পাশে ফুটনোটের মতো থেকে যাওয়া জীবনের এই শিক্ষাটুকুই বহু বছর মনে তুলে রাখবেন ফুটবলপ্রেমীরা। ঘটনার ঘনঘটায় বিশ্ব ফুটবল বদলাবে। হয়তো মেসির জায়গা নেবেন অন্য কেউ। আর্জেন্টিনার বদলে কোপা জিতবে অন্য কোনও দেশ। তবু ফুটবল মানচিত্রে চিরকাল থেকে যাবে আলাদা একটি দেশ। নাম তার মেসিদেশ। সেই দেশের নাগরিকরা আজীবন জানবেন, টুর্নামেন্ট জেতা অছিলা মাত্র, আসলে জিততে হয় জীবনের যুদ্ধ। কীভাবে তা জিততে হয়, দেখিয়েছিলেন একজনই। নাম তাঁর লিওনেল মেসি।