সময়ের স্রোতে যখন আমাদের সমস্ত বিশ্বাস ভেঙে যাচ্ছে, আমাদের সামনে যাঁদের খুঁটি হয়ে দাঁড়ানোর কথা ছিল তাঁরা আত্মবিস্মৃত হচ্ছেন, তখন সুনীল ছেত্রী ফ্রন্ট হয়ে যান। সংহতির বোধ সুনীলের দু’পায়ে যেমন আছে, তেমনই আছে তাঁর যাপনে। তাই তিনি এ দেশের যথার্থ অধিনায়ক। লিখলেন অর্পণ গুপ্ত।
এই জন্মদিনে সুনীল ছেত্রী উনচল্লিশে পড়লেন। এ বড় আনন্দের, নাকি মনখারাপের খবর, তা বুঝতে পারছি না। মনে আছে সাফ কাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর একজন লিখেছিলেন- ‘ভারতের সৌভাগ্য একজন সুনীল ছেত্রী আছেন, আবার ভারতের দুর্ভাগ্য যে একজনই সুনীল ছেত্রী আছেন…’। ভারতবর্ষের ফুটবল ইতিহাসে যদি বিখ্যাত ও জনপ্রিয় ফরোয়ার্ডদের তালিকা প্রস্তুত করা হয়, তবে পাঁচ-ছয়ের দশকে তুলসীদাস বলরাম-পিকে ব্যানার্জি-চুনী গোস্বামী, সাতের দশকে সুভাষ ভৌমিক-শ্যাম থাপা, আট ও নয়ের দশকে শিশির ঘোষ, আই এম বিজয়ন, এই শতকের প্রথম দশকে বাইচুং এবং তারপর থেকে সুনীল ছেত্রী-র নাম আসবে। সুনীল সাফ কাপে যখন সর্বোচ্চ গোলদাতার সম্মান পেলেন তখন মনে হল- উনচল্লিশে পড়া এক চিরতরুণ কাকে দিয়ে যাবেন তাঁর ব্যাটন? এ-প্রশ্ন ভারতীয় ফুটবলে ঘুরে বেড়ায় আজকাল, কিন্তু সুনীল মানে কেবলই দেশের সবচেয়ে ভরসাযোগ্য ফুটবলার নয়, বরং তিনি অনেক বেশি করে একজন অধিনায়ক। এই যে একটি জনতার স্রোতের সামনে তিনি বিগত কয়েক বছর ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন, বলা ভালো জনতা তাঁকে আঁকড়ে ধরে দাঁড় করিয়েছে লাইনের একেবারে সামনে, তা কেবলই ওই সাইডলাইনের ভেতর তাঁর অমর গাথার জন্য নয়, তাঁর স্বতন্ত্র যাপনও এর অন্যতম কারণ।
আরও শুনুন: গুলি-বারুদে নয়, গোলের হিসাবে লেখা স্বাধীনতার সোনালি ইতিহাস
ক্ষমতার সামনে নতমস্তক থেকে নিজের কাজ হাসিল করার যে শিক্ষা বর্তমানে আমাদের তথাকথিত আইকনেরা দিয়ে চলেছেন, বা বলা ভালো, রাষ্ট্রীয় শোষণ কিংবা অত্যাচারকে নিঃশব্দে আত্তীকরণ করে নীলকণ্ঠ হয়ে ওঠা এই সব ‘দেবতাদের’ মন্দিরে সুনীল ছেত্রী একজন নির্ভেজাল নাস্তিক। তাঁর উপর দেবত্ব আরোপের জন্য হাহাকার করেন না ভক্তকুল। মাঝে মাঝে মনে হয়, ভারতবর্ষে ক্রিকেটের উত্তুঙ্গ জনপ্রিয়তা কোথাও গিয়ে সুনীলের উপর থেকে সরিয়ে দিয়েছে পলিটিক্যাল কারেক্টনেসের অদৃশ্য দায়টুকু। বহুজাতিক সংস্থার পণ্যের বিজ্ঞাপনে ঘন ঘন মুখ দেখানোর দায় তাঁর নেই, ইমেজ পরিচর্যার জন্য দামি ফেস ক্রিম থুড়ি চমৎকার পাবলিক রিলেশনের খিদে তাঁর নেই, বরং উগ্র জাতীয়তাবাদী আবহে সুনীল এক স্বতন্ত্র কমিউন, যেখানে ভারতের জাতীয়তাবোধের চিরকালীন স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে পড়তে পারে।
সুনীল ছেত্রীর সবচেয়ে বড় সাফল্য কী?
রেকর্ডের পাতা ওলটালে, তিনি দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চে সর্বোচ্চ গোলস্কোরার। পরিসংখ্যানের নিরিখে তিনি দেশের ফুটবলের সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলারও বটে। এ তো বহুল চর্চিত এবং লিখিত; কিন্তু তাঁর সাফল্যকে নিক্তিতে মাপা হলে যে বিষয়টি সবার আগে উঠে আসবে, তা হল তিনি স্থাণু সময়ে দাঁড়িয়ে সমাজের এক আয়না হতে পেরেছেন, যার সামনে সাদা আর কালোর প্রভেদ স্পষ্ট হয়ে যায়। দেশের হয়ে পদকজয়ী কুস্তিগিররা দিল্লির রাজপথে আন্দোলন করছেন, তাঁদের দাবি এক ক্ষমতাশীল সাংসদের গ্রেপ্তারি, যিনি মহিলা কুস্তিগিরদের যৌন নির্যাতনের দায়ে অভিযুক্ত। এ আন্দোলনে পুলিশের ভূমিকা, দেশের সরকারের ভূমিকা আমাদের সকলেরই জানা। তাঁর চেয়েও বেশি করে জানা দেশের তারকা-মহাতারকা ক্রিকেটারদের অদ্ভুত মৌনব্রত অবলম্বন। সুনীল ছেত্রী এই সময়ে একটি টুইট করেন। খুব সাধারণ একটি বিবৃতি। তিনি লেখেন, ‘দেশের হয়ে পদকজয়ী কুস্তিগিরদের কেন এভাবে রাস্তা থেকে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হবে? এভাবে কোনও মানুষের বিরুদ্ধেই ক্ষমতাকে প্রয়োগ করা যায় না, কোনও মানুষের সঙ্গেই এমন ব্যবহার কেউ করতে পারে না। আমি চাই, এই পরিস্থিতি যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত, সেভাবেই যেন নিয়ন্ত্রণ করা হয়।’ এই বিবৃতির কোথাও কোনও রাজনৈতিক দলকে সরাসরি আক্রমণ করা নেই, কোথাও শালীনতার সীমা ছাড়ানো নেই, কোথাও রাজনৈতিক পক্ষ নেওয়াও নেই, তবু দেশের আপামর জনতার চোখে এই ট্যুইটের পর সুনীল এক উঁচু আসন পেলেন। এর কারণ, বাকি আইকনদের থেকে এটুকু সহমর্মিতাও তাঁরা পাননি, পক্ষ বা বিপক্ষে থাকার চেয়েও জরুরি, দেশের জনতার সঙ্গে ব্যক্তির একটি সমষ্টিবোধ গড়ে তোলা- দুর্ভাগ্যের বিষয় জনতার এটুকু অনুভবের চাহিদাও নস্যাৎ হয়ে গেছে বারে বারে।
আরও শুনুন: জোকারের নির্লিপ্তি ভেঙে অশ্রু ঝরালেন আলকারাজ, উইম্বলডনে অভিষেক নতুন নায়কের
আন্তর্জাতিক ফুটবলের সর্বোচ্চ গোলস্কোরারদের তালিকা খুললে লিওনেল মেসি ও ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো নামক দুই ভিনগ্রহের মহাতারকার পাশে ছোটোখাটো চেহারার এক ভারতীয়, বিশ্ব র্যাঙ্কিং-এ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে প্রথম একশোতে থাকা এক দেশের অধিনায়ক। সুনীল ছেত্রীর লড়াই ছিল বিগত পাঁচ দশকে রোম্যান্টিসিজম-সর্বস্ব ভারতীয় ফুটবল, যা কিনা ১৯৭০ এশিয়ান গেমসের পর বিস্মৃত হয়ে আর কোনও দিন এশীয় ফুটবলের মানচিত্রে স্বমহিমায় ফিরে এল না, তাঁকে ফের ঘুরে দাঁড় করানো। এ লড়াইয়ের গোড়ার দিন থেকেই তিনি জানতেন তিনি অসম্ভব একা, আর সমস্ত শর্ত মেনেই তিনি সে ক্রুশকাঠ কাঁধে তুলেছেন। ক্রিকেট ধর্মের দেশে মধ্য তিরিশ পেরিয়েও তিনি নিঃশব্দে তাঁর কাজ করে চলেছেন, সাফ চ্যাম্পিয়ন করছেন দেশকে, বিশ্বকাপ কোয়ালিফায়ারের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করছেন, সুযোগ করে নিয়েছেন এশিয়া কাপেও। ম্যাচের পর তাঁর গর্ভবতী স্ত্রীর হাতে আর্মব্যান্ড পরিয়ে বলেন- ‘আমি ও আমার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা’- প্যাট্রিয়ার্কাল সমাজে নারীদের সন্তান জন্ম দেওয়ার ওপর যে মহত্ত্ব আরোপ করা হয়, যৌথতার বোধ দিয়ে তাঁকে ভাঙলেন সুনীল।
সম্প্রতি তাঁর শ্বশুরমশাই, প্রাক্তন ভারতীয় ফুটবলার সুব্রত ভট্টাচার্যের আত্মজীবনী প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসে সুনীল বলেন- ‘আমাকে কোচ শিখিয়েছিলেন, একজন ফুটবলার যখন হয়েছ তখন নিজের কথা ভুলে যাও, তুমি তোমার দেশের জন্য খেলো, তোমার ক্লাবের জন্য খেলো, তোমার দলের জন্য খেলো, এটাই তোমার পরিচয়…’- সুনীল বোধ করি একজন পাহাড়ি তরুণ হয়ে যতখানি আত্মস্থ করতে পেরেছেন এ সত্যকে, দেশের বহু তাবড় ক্রীড়াবিদই তা করতে অপারগ।
একজন প্লেয়ারের অস্তিত্ব এই সমষ্টিবোধে। দলগত সংহতি আমাদের একের সঙ্গে একাধিক মননের সুতো জুড়ে দেয় অচিরেই। এই সংহতির বোধ সুনীলের দু’পায়ে যেমন আছে, তেমনই আছে তাঁর যাপনে- তাই তিনি এ দেশের যথার্থ অধিনায়ক। সময়ের স্রোতে যখন আমাদের সমস্ত বিশ্বাস ভেঙে যাচ্ছে, আমাদের সামনে যাঁদের খুঁটি হয়ে দাঁড়ানোর কথা ছিল তাঁরা আত্মবিস্মৃত হচ্ছেন, তখন সুনীল ছেত্রী ফ্রন্ট হয়ে যান।
জন্মদিনে তাঁর বাড়ির সামনে লক্ষ লক্ষ ভক্তসমাবেশ হয়তো হবে না, কিন্তু এ দেশের আমজনতার মনে তাঁর মাঠের ভেতর ক্যাপ্টেন্সি আর্মব্যান্ড পরিহিত ইমেজটুকুই একমাত্র নয়, বরং জনগণমনের অধিনায়ক হিসেবে কবেই মানুষ তাঁকে স্বীকৃতি দিয়ে দিয়েছেন- সুনীলের সর্বশ্রেষ্ঠ সাফল্য বোধ হয় এটাই।…