১৯৮৩ সালের ২৫ জুন। বিশ্বমঞ্চে ভারতীয় ক্রিকেটের জয়যাত্রার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত স্বাক্ষরিত হয়েছিল সেদিনই। তারপর কেটে গিয়েছে চারটে দশক। সময় বদলে গিয়েছে, পালটে গিয়েছে দেশের মন আর মানুষ। তবু আজও যেন দেশবাসী বুকের গভীরে কান পেতে শুনতে পায় শত ঝরনার জলোচ্ছ্বাস। ২৫ জুন আধুনিক পৃথিবীতে নতুন ভারতবর্ষের মাথা তুলে দাঁড়ানোর দিন। ভারতীয় জীবন-যাপনে সেই দিনটির মাহাত্ম্য অপরিসীম, লিখলেন বোরিয়া মজুমদার।
দেখতে দেখতে চল্লিশটা বছর অতিক্রান্ত। ১৯৮৩-র কপিল দেবদের বিশ্বকাপ জয়ের এটা ৪০তম বর্ষপূর্তি – ভাবতেই ভারতীয় হিসাবে যেমন গর্ব হচ্ছে, তেমনি আলাদা একটা রোমাঞ্চ অনুভব করছি। সেই মুহূর্ত-উদযাপনে মুম্বইয়ে মিলিত হচ্ছেন ’৮৩-র বিশ্বজয়ী নক্ষত্ররা। তাঁদের স্মৃতিচারণায় আবার জেগে উঠবে সেই সোনালি অতীত।
আচ্ছা, বলুন তো ৪০ বছর পরেও কি আজও ’৮৩-র সেই বিশ্বকাপ জয় একইরকম অর্থবহ? প্রাসঙ্গিক? একইরকম তাৎপর্য বহন করে আমাদের যুবসমাজে ? ১৯৮৩-র ২৫ জুন যখন ভারত বিশ্বকাপ জেতে তখন আমার মাত্র সাত বছর বয়স। সত্যি কথা বলতে, আমি মহিন্দার অমরনাথের ওই অমরত্ব লাভ করা ওয়েস্ট ইন্ডিজের শেষ উইকেট শিকার চাক্ষুষ করিনি। দেখিনি বিশ্বজয়ের পরমুহূর্তে অনুরাগীদের ভালবাসার অত্যাচার থেকে বাঁচতে জিমির সেই প্রাণপণ দৌড়। যেমন দেখা হয়নি এমএস ধোনির ওয়াংখেড়েতে সেই স্বপ্নপূরণের ছয়। এই ব্যাপারে শচীন তেণ্ডুলকরের সঙ্গে আমার দারুণ মিল!
আরও শুনুন: ঐতিহাসিক ২৫ জুন! বিশ্বজয়ের শ্যাম্পেন সেদিন কার থেকে নিয়েছিলেন কপিল দেব?
পরে অবশ্য ভিডিও-তে দেখেছি। কয়েক হাজারবার দেখেছি। যতবার দেখেছি, মুগ্ধতার রেশ জন্মেছে তার চেয়েও কয়েকগুণ। মজার ব্যাপার, ’৮৩-র সেই ফাইনালে ভারত যখন ১৮৩ রানে অলআউট হয়ে যায়, প্রবল হতাশায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আর পাঁচটা ভারতীয়ের মতোই ওই বয়সে এটা উপলব্ধি করতে অসুবিধা হয়নি, এই সামান্য রান তাড়া করে জেতা গর্ডন গ্রিনিজ, ডেসমন্ড হেইন্স, স্যর ভিভিয়ান রিচার্ডস, ক্লাইভ লয়েড সমৃদ্ধ ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে স্রেফ জলভাত।
আমার ঘুম ভেঙেছিল ভারতীয় ক্রিকেটের এক নতুন ভোরে। যে প্রত্যুষে আমরা নিজেদের শনাক্ত করেছিলাম ‘বিশ্বচ্যাম্পিয়ন’ রূপে। কী আশ্চর্য সমাপতন! ১৯৮৩-র যে ২৫ জুন এই বিশ্বজয়ের মাহেন্দ্রক্ষণের সাক্ষী থেকেছিল কপিল দেবের ভারত, অর্ধশতাব্দী পূর্বে, ১৯৩২-এর সেই ২৫ জুনেই বিশ্ব ক্রিকেট আঙিনায় পথ চলা শুরু হয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেটের।
’৮৩-র সেই বিশ্বকাপের সঙ্গে আমার দ্বিতীয় সাক্ষাৎ ঠিক ২৫ বছর পর। জুন, ২০০৮-এ। লর্ডসের গ্রন্থাগারে বসে গবেষণার কাজ করছি, হঠাৎ খেয়াল করলাম, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার জন্য ট্রফিটা আনা হয়েছে। রাখা ছিল ঠিক আমার কয়েক ফুটের মধ্যে। স্টাফদের কথায় বুঝতে পারলাম, ’৮৩-র বিশ্বকাপ জয়ের ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে কপিল দেবের সেই বিশ্বজয়ী ভারতীয় দল লর্ডসে আসবে, তাঁদের হাতে তখন তুলে দেওয়া হবে ট্রফি।
যাই হোক, আমি মনের সুপ্ত ইচ্ছাটাকে আর চেপে রাখতে পারছিলাম না। লর্ডসের সংগ্রহশালার কিউরেটর অ্যাডাম চ্যাডউইকের সঙ্গে আগেই পরিচয় ছিল। ওকে গিয়ে বললাম, মনের ইচ্ছাটা- একবার ট্রফিটা হাতে ধরতে চাই। চ্যাডউইক স্মিত হেসে অনুমতি দিতেই আমার মানস-কল্পনা বাঁধ ভাঙল। ট্রফিটা হাতে নিয়ে লর্ডসের ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াতে ইচ্ছা হল, ঠিক যেভাবে ১৯৮৩-র বিশ্বকাপ জয়ের পর ট্রফি হাতে দাঁড়িয়েছিলেন কপিল দেব। যেমন ভাবনা, তেমন কাজ। চ্যানউইকের অনুমতি নিয়েই মনের আশ মিটিয়েছিলাম। লর্ডসের ব্যালকনিতে প্রুডেন্সিয়াল কাপ হাতে দাঁড়ানোটা আমার কাছে ছিল একটা ফ্যানবয় মোমেন্ট।
আরও শুনুন: ১৯৮৩-র জয় শুধু ক্রিকেটের নয়! সাদা-কালো অবয়ব থেকে শুরু রঙিন ইন্ডিয়ার জয়যাত্রা
সেই মুহূর্তে প্রাণের যে উচ্ছ্বাস, আবেগের যে স্ফূরণ উপলব্ধি করেছিলাম, কয়েক ঘণ্টা পর সান্ধ্যকালীন লর্ডসের বুকে একই অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ দেখেছিলাম ’৮৩-র বিশ্বজয়ীদের মধ্যে। দেখেছিলাম অকাতরে তাঁদের অটোগ্রাফ বিলোতে, দেখেছিলাম উল্লাসের সেই মুহূর্তকে প্রিয়জনের সঙ্গে ক্যামেরাবন্দি করে রাখতে। যেন স্মৃতির সরণি বেয়ে পুনরপি তাঁরা ফিরে গিয়েছিলেন ২৫ বছর আগের মুহূর্তে, ১৯৮৩-র ২৫ জুনে।
সত্যি অর্থেই সেদিন অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়েছিলেন কপিল দেব, অমরনাথরা। কে ভেবেছিল ভারত বিশ্বকাপ জিতবে! যাঁরা কিনা ১৯৭৫-এর প্রথম সংস্করণে আবির্ভাবেই হেরেছিল ২০২ রানে। ৬০ ওভারে তুলেছিল মাত্র ১৩৬ রান। শুধু তাই নয়, পরেরবার ১৯৭৯-এর বিশ্বকাপে যাঁরা কিনা একটা ম্যাচেও জয়ের মুখ দেখেনি। সেই ভারতীয় দলের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়াটা ছিল আক্ষরিক অর্থেই রূপকথার বাস্তবায়ন। ক্রিকেটের মক্কায় ভাগ্যের চাকা বদলের সেই দুরূহ কাজটা করে দেখিয়েছিলেন কপিল ও তাঁর সহযোদ্ধারা। ইংলিশ কন্ডিশনে পরপর অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে তাঁরা সোচ্চারে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছিলেন সেই অমোঘ সত্য – হ্যাঁ, আমরাও পারি।
ভারতের সেই প্রথম বিশ্বকাপ জয়কে আধার করে যে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছিল, সেই ‘৮৩’-র পরিচালক কবির খান এক সাক্ষাৎকারে যথার্থই বলেছেন, “১৯৮৩-র বিশ্বকাপ জয় কোনও সাধারণ টুর্নামেন্ট জয় ছিল না। এই সাফল্যগাথা বদলে দিয়েছিল গোটা দেশকে। পরিচালক হিসাবে আমার কাছে চ্যালেঞ্জ ছিল, এই সিনেমায় সেই বিবর্তনের রূপরেখাকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তুলে ধরা। বিশ্বকাপ জয়ের সেই গুরুত্বকে উপলব্ধি করার দায় ও দায়িত্ব আমাদের সবার রয়েছে। যারা স্পোর্টসকে ভালবাসেন, তাঁরা ৮৩-কেও অচিরেই আপন করে নেবেন।”
’৮৩-র বিশ্বকাপ জয় তাই প্রতিটি ভারতীয়ের জীবনেই একটা বিশেষ মুহূর্ত। যার উদযাপনে একই সঙ্গে গর্বিত ও অনুপ্রাণিত হওয়া যায়। এই উপলব্ধি শুধু ভারতীয় ক্রিকেট পরিসরে নয়, সমাজের সর্বস্তরে যাপিত জীবনের স্মৃতি-সত্তা-ভবিষ্যতে বয়ে চলেছে ফল্গুধারার মতো।