এই জগতে যা ঘটেছে বা ঘটতে চলেছে সবই ঈশ্বর নির্দিষ্ট। একথার মান্যতা দেন সাধকরাই। তবে বর্তমানে অনেকেই হয়তো তেমনটা মনে করেন না। যাঁর পুজোর আয়োজনে যত বেশি আড়ম্বর, তাঁর পুজোতেই ভগবানের তুষ্ট হওয়ার প্রবণতা তত বেশি। এই ধারণা কমবেশি প্রায় সকলেরই। কিন্তু সত্যিই কি তাই? ভগবান স্বয়ং কী বলেছেন এই বিষয়ে? আসুন শুনে নিই।
মন্দিরে ঢোকার জন্য আলাদা মুল্য। পুজো দেওয়ার আলাদা। সেই হিসাবে খরচ করলেই বিগ্রহের সামনে যাওয়ার সুযোগ মিলবে। কিন্তু তাও মাত্র কিছুক্ষণের জন্য। এর বেশি কিছু পেতে হলে, খরচও করতে হবে সেই মতো। তাই ভগবানের কাছে কে কতক্ষণ থাকবেন কিংবা কার দেওয়া মালা সরাসরি ভগবানের গলায় উঠবে, তা নির্ধারিত হয় টাকার অঙ্ক মেনে।
আরও শুনুন: কোথাও প্রসাদ মদ, কোথাও বছরভর জলের তলায় মহাদেব, দেশের ৫ বিশেষ শিবমন্দির চেনেন?
ভগবানের আশীর্বাদ পেতে কে না চায়? তাই যাঁর যেমন সামর্থ সেইমতো উজাড় করে দেওয়ার চেষ্টা করেন। দেশের যে কোনও বড় মন্দিরে এই টাকার দেওয়ার নিয়ম চোখে পড়ে। যত বেশি খরচ হবে ভগবানের ততটাই কাছে যাওয়ার সুযোগও মিলবে। শুধু তাই নয়। মন্দিরে প্রসঙ্গ বাদ দিলেও ভগবানের আরাধনায় টাকার প্রসঙ্গ বারে বারেই উঠে আসতে পারে। নিত্য পুজোর চল অনেকের বাড়িতেই থাকে। সেক্ষেত্রে কেউ ভক্তিভরে ঠাকুরের সামনে দুটি নকুলদানা রাখেন, আবার কেউ সাজিয়ে দেন রাজভোগ। আর বড় কোনও পুজো হলে তো কথাই নেই। ঠাকুর মশাই নিজেই ঠিক করে দেবেন, কত দামের চাল, ডাল কিংবা ঘি দিতে হবে নৈবেদ্য। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে কোন মিষ্টি দিলে ঠাকুর তুষ্ট হবেন, তাও নির্দিষ্ট করে দেন পুরোহিত। সমাজের চোখে এই নিয়মে কোনও ভুল নেই। যার পুজোর বহর যত বেশি, সেখানে দৈবের উপস্থিতিও যেন ততটাই গাঢ়। কিন্তু শাস্ত্র কি আদৌ এই নিয়মকে মান্যতা দেয়? কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে স্বয়ং শ্রী কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন,
পত্রং পুষ্পং ফলং তোয়ং যো মে ভক্ত্যা প্রযচ্ছতি।
তদহং ভক্ত্যুহৃত্মশ্মামি প্রযতাত্মনঃ।।
অর্থাৎ,
যিনি আমাকে পত্র,পুষ্প,ফল, জল, যাহা-কিছু ভক্তিপূর্বক দান করেন,
আমি সেই শুদ্ধচিত্ত ভক্তের ভক্তিপূর্বক প্রদত্ত উপহার গ্রহণ করিয়া থাকি।।
আরও শুনুন: বাড়িতে শিবলিঙ্গ রেখেছেন? পুজোর সময় ভুলেও এই কাজ করবেন না
সুতরাং একথা বলাই যায়, ভগবান দ্রব্যের কাঙাল নন। তিনি ভক্তির কাঙাল। তাঁকে উপহার আর নৈবেদ্যর আড়ম্বরে ঢেকে ফেলা, আসলে আরও দূরে যাওয়ার সমান। মনের ভক্তি থাকলে তিনি যে কারও কাছে ধরা দেন। পুরাণের গল্পে এমন উদাহরণের সংখ্যা নেহাতই কম নয়। ভগবান নিজেই বলছেন, তাঁর পূজা অনায়াস সাধ্য। কিছুক্ষেত্রে আচার অবশ্যই রয়েছে, তবে তার কোনটাই ভক্তি অপেক্ষা বড় নয়। জীবনের সত্য আসলে দুটি। জন্ম ও মৃত্যু। আজ যা বর্তমান আগামিদিনে তাই অতীত। এই সারসত্যকে ভুলে আমরা স্বার্থের পিছনে ছুটি। কী করলে নিজের স্বার্থসিদ্ধি হবে সেদিকেই সবার লক্ষ্য। তবে সাময়িক সুখের সেই পথে মোক্ষ লাভ হয় না। তা মিলতে পারে ভক্তির সাগরে ডুব দিলেই। সেখানে কোনও আড়ম্বরের প্রয়োজনীতা নেই। মন দিয়ে ডাকতে জানলে, ঈশ্বর ঠিকই সাড়া দেবেন। আর উদ্দেশ্য যদি হয় ভাল থাকার, তবে সেই পথও সুগম করবেন স্বয়ং তিনিই।