পিতৃপক্ষের অবসান। দেবীপক্ষের সূচনা। সন্ধিক্ষণে মহালয়া। এ তিথি শুভ নয়। শাস্ত্রেই তার ব্যাখ্যা মেলে। তবে এই দিন বিশেষ কিছু কাজ করলে সারা বছর ভালো কাটতে বাধ্য। ঠিক কীভাবে পালন করবেন মহালয়ার দিনটি? আসুন শুনে নিই।
“আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জীর…”।
মহালয়ার ভোরে অনেকেরই ঘুম ভাঙে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চিরন্তন কন্ঠ শুনে। বেতারের অনুষ্ঠানে, দেবী মাহাত্ম্যের অপূর্ব বর্ণনা। যা শোনার জন্য বাঙালি সারা বছর অপেক্ষা করতে রাজি। সেই অর্থে মহালয়া দেবীর পুজো আরম্ভের দিন নয়। তবে এই ভোরের সঙ্গে দুর্গাপুজোর যোগ নিবিড় একথা বলাই বাহুল্য। তাহলে মহালয়া আসলে কী?
মহালয়া শব্দের অর্থ মহান যে আলয়। কথাটির ব্যাখ্যা নানা ভাবে করে থাকেন প্রাজ্ঞজনেরা। যেহেতু মহালয়া থেকেই দেবী দূর্গার আবাহন মুহূর্তটি চিহ্নিত হয়ে যায়, তাই অনেকের মতে এই আলয় বা আশ্রয় দেবী নিজেই। আবার এমনটাও অনেকে বলে থাকেন, এই মহান আলয়-র অর্থ পিতৃলোক। যেহেতু এটি পিতৃপক্ষের অবসান চিহ্নিত করে। তাই এইদিনে সেই লোকের বাসিন্দাদের উদ্দেশে জলদানের নিয়ম রয়েছে। আর এই নিদানও দেয় শাস্ত্রই। সেখানে স্পষ্ট উল্লেখ মেলে পিতৃপক্ষের এক পক্ষকাল, অর্থাৎ ১৫ দিনের জন্য পিতৃপুরুষরা মনুষ্যলোকের কাছাকাছি চলে আসেন। পুরাণমতে, ব্রহ্মার নির্দেশেই গড়ে ওঠে এই মহামিলনক্ষেত্র। এই সময় তাই পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণ করা উচিত।
তাহলে তর্পণ কী?
দেবগণ, ঋষিগণ, পিতৃগণ, নরগণ – ব্রহ্মা হইতে তৃণশিখা পর্যন্ত সমস্ত জগৎ আমা কর্তৃক প্রদত্ত অন্নজলে তৃপ্তিলাভ করুন। এই হল তর্পণের গূঢ় অর্থ। শাস্ত্র বলে, ‘সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম’- অর্থাৎ, সমস্ত জগৎ ব্রহ্মময়। তাই জলদান করতে হয় সর্বভূতের উদ্দেশ্যেই। যেহেতু পিতৃপক্ষে পিতৃলোক ও মনুষ্যলোক কাছাকাছি চলে আসে, তাই ধারণা করা হয়, এই সময়কালে যদি পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণ অর্থাৎ জলদান করা হয়, তবে তা তাঁদের কাছে সহজে পৌঁছায়। যার মহাপ্রকাশ পিতৃপক্ষের শেষ দিনটিতে অর্থাৎ মহালয়ায়। এই কারণেই পিতৃপক্ষের অবসানে মানুষ তর্পণে রত হন। শাস্ত্রে কথিত আছে, এই দিনেই মহিষাসুর বধের দায়িত্ব গ্রহণ করেন দেবী দুর্গা। মহিষাসুরের হাত থেকে দেবগণকে উদ্ধার করার লগ্ন যেহেতু এখান থেকেই সূচিত হচ্ছে, তাই পরমা প্রকৃতি বিশ্বজননীর আশ্রয়ই হল মহান আলয়, এমত মত পোষণ করেন অনেকে।
সুতরাং একথা বলাই যায়, মহালয়ার এক নয়, অনেকগুলো বিশেষ দিক রয়েছে। একদিকে যেমন রয়েছে দেবী দুর্গার প্রসঙ্গ। অন্যদিকে তেমনই পিতৃপুরুষদের পুনরায় মনুষ্যলোক থেকে অনেকটা দূরে চলে যাওয়ার দিন। সেই হিসেবে মহালয়া শুভ না অশুভ, এ নিয়ে যথেষ্ট তর্ক চলে। কেউ কেউ বলে থাকেন, এই দিনটি শুভ নয়। কারণ এইদিন পিতৃপুরুষের স্মরণ করা হয়। বা একে শ্রাদ্ধের দিনও বলা যেতে পারে। তাই প্রকৃতপক্ষে এ আসলে শোকের দিন। মতান্তরে, হিন্দু শাস্ত্রে যে কোনও শুভ কাজের সূচনাতেই পিতৃপুরুষকে স্মরণ বা তর্পণ করা হয়। যে রীতি হিন্দুর নিত্য পঞ্চমহাযজ্ঞের অন্তর্গত, তাকে অশুভ বলাও বাঞ্ছনীয় নয়। তবে তর্পণের বৃহত্তর অর্থটি ধরতে হয়, তবে তা আসলে ইঙ্গিত দেয় জগৎব্যাপী এক মহামিলনক্ষেত্রের। সুতরাং মিলনের এই মুহূর্ত এবং তার উদযাপন কোনোভাবেই অশুভ হতে পারে না। তবু এই দিন যে শোকের একথা অস্বীকারের উপায় নেই। তাই সেই অর্থে একে ভীষণ আনন্দের দিনও বলা চলে না। এবার আসা যাক এইদিন কী করবেন না, সেই প্রসঙ্গে।
শুভ হোক বা অশুভ, মহালয়া যে বিশেষ তিথি সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তাই এইদিন কিছু নিয়ম মেনে চলা উচিত। শাস্ত্রমতে সেইসব নিয়ম পালন করলে সারাবছর তার প্রভাব থাকে। প্রথমত এইদিন চেষ্টা করবেন মিথ্যা কথা না বলার। অনেকেই হয়তো একে খুব সাধারণ ভাবে দেখেন, তবে এই কাজের প্রভাব মারাত্মক হতে পারে। পাশাপাশি এইদিন চেষ্টা করুন ভোরে উঠে পড়ার। এইদিনের ভোর বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। মহালয়ার দিন কোনও শুভকাজের শুরু না করাই ভাল। যেমন এই দিনটিতে কারও বিয়ের কথা বলবেন না। বাড়ি, গাড়িও না কেনাই ভাল। এদিন ব্যবসার সূচনা করাও উচিত নয়। এইদিন অনেকে নিরামিষ খান, সেটিও একদিক থেকে মঙ্গলের। তবে এইদিন কাউকে কিছু দান করা বিশেষ পুণ্যের। মহালয়ার দিন এই ধরনের কাজ করলে সারাবছর ভালো কাটে। পিতৃপুরুষের আশীর্বাদে কেটে যায় সমস্ত বাধা বিপত্তি। সেইসঙ্গে তাঁরাও বিশেষ তৃপ্তি পান।