দোলপূর্ণিমা মানেই আনন্দের রঙিন সমাহার। একইসঙ্গে এই দিন হিন্দু ধর্মের এক উল্লেখযোগ্য তিথি। কিন্তু জানেন কি, ঠিক ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমাতেই কেন পালন করা হয় এই উৎসব? নেপথ্যে কি শুধুই শ্রী বিষ্ণুর লীলা, নাকি অন্য কোনও দেবতাও দোল উৎসবের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত? আসুন, শুনে নিই।
দোলের উদযাপন কেবল এই যুগেই সীমাবদ্ধ নয়, পুরাণেও উল্লেখ রয়েছে এই উৎসবের। এই উৎসবকে ঘিরে একাধিক পৌরাণিক অনুষঙ্গের সন্ধান পাওয়া যায়। যার মধ্যে রয়েছে কীভাবে এই উৎসবের সূচনা হল সে কাহিনিও। যদিও সে নিয়ে বেশ কয়েকটি মত প্রচলিত রয়েছে।
আরও শুনুন: শ্রাদ্ধশান্তি পছন্দ নয়, তাই ক্যানসারের শেষ পর্যায়ে এসে উদ্দাম পার্টির আয়োজন ৭৬ বছরের মহিলার
বিভিন্ন আখ্যানের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রহ্লাদের ভক্তিলীলার প্রসঙ্গটি। ভাগবত পুরাণ মতে, দোর্দণ্ডপ্রতাপ রাজা হিরণ্যকশিপু বিষ্ণুর প্রবল বিরোধী ছিলেন। কিন্তু এমনই ভাগ্য, তাঁর সন্তান প্রহ্লাদ কালে কালে ভগবান বিষ্ণুর একান্ত ভক্ত হয়ে ওঠেন। অনেক চেষ্টা করেও প্রহ্লাদকে তাঁর নিজস্ব বিশ্বাস থেকে সরিয়ে আনতে পারেননি হিরণ্যকশিপু। তাই তাঁর জন্য মৃত্যুদণ্ড ধার্য করেন তিনি। নিজের বোন হোলিকার সাহায্যে প্রহ্লাদকে পুড়িয়ে মারতে চাইলেন তিনি। হোলিকার ছিল এক মায়া আবরণ, যা গায়ে থাকলে আগুন তাকে ছুঁতে পারবে না। সেই আবরণ গায়ে জড়িয়ে প্রহ্লাদকে নিয়ে আগুনে প্রবেশ করল সে। কিন্তু বিষ্ণুর কৃপায় ফল হল বিপরীত। আগুনে পুড়ে মৃত্যু হল হোলিকারই, আর প্রহ্লাদের গায়ে আঁচটুকুও লাগল না। পুরাণে বর্ণিত এই ঘটনাকে স্মরণ করেই দোলের আগের দিন হোলিকা দহনের প্রচলন হয়েছে। চলতি কথায় যার নাম ন্যাড়াপোড়া। অশুভ শক্তির বিনাশের উদ্দেশ্যে পালন করা হয় এই প্রথা। তবে এই ব্যাখ্যায় সঠিক ভাবে ফাল্গুন মাসে দোল উদযাপনের কারণ পাওয়া যায় না।
সে কথার প্রমাণ মেলে পুরাণের অন্য একটি কাহিনি থেকে। প্রাচীন ভারতে দোল মানেই ছিল মদনোৎসব। প্রেমের দেবতার পূজার্চনার সঙ্গে সঙ্গে প্রেমিক-প্রেমিকাদের মিলন উৎসব উদযাপন করা হত এই দিনে। আর সেই প্রথার নেপথ্যে থাকা পৌরাণিক কাহিনিই নির্দেশ দেয় বাংলার এই বিশেষ মাসটিকে। তা কী ছিল সেই কাহিনিতে?
আরও শুনুন: প্রাক্তন প্রেমিকার নামেই সদ্যোজাত কন্যার নাম রাখতে চান ব্যক্তি, চটে লাল স্ত্রী
সেকথা জানতে গেলে চোখ রাখতে হবে শিবপুরাণে। পুরাণ অনুসারে, দক্ষযজ্ঞে অপমানিত হয়ে সতী যখন প্রাণত্যাগ করলেন, দুঃখে রাগে শিব বসলেন ধ্যানে। এদিকে হিমালয়কন্যা উমা রূপে জন্ম নিলেন সতী। মহাদেবের ধ্যান ভাঙানোর জন্য উমার সঙ্গে জোট বাঁধলেন কামদেব মদন। মদনের বাণে শিবের ধ্যান ভাঙল বটে, কিন্তু শিবের ত্রিনয়নজাত আগুনে ভস্ম হয়ে গেলেন মদন। পুরাণমতে মদনদেব ভস্ম হওয়ার সেই দিনটি ছিল, ফাল্গুন মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমী। এদিকে স্বামীর মৃত্যুতে ব্যাকুল হয়ে পড়লেন কামদেবের স্ত্রী রতিদেবী। সেইদিন থেকেই তিনি শুরু করেন মহাদেবের ধ্যান। রতির দুঃখে বিষণ্ণ হয়ে পড়ে প্রকৃতিও। টানা সাতদিন সেই ধ্যানের পর মহাদেব তুষ্ট হন। রতির প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে মদনদেবের প্রাণ ফিরিয়ে দেন তিনি। সেই খুশিতে আবার রঙিন হয়ে ওঠে প্রকৃতি। হিসাবমতো দিনটি ছিল ফাল্গুন পূর্ণিমা। মদনের পুনর্জন্মের এই দিনটিই ছিল দোল উৎসবের তিথি। সেই থেকেই এই দিন রঙের উৎসব পালিত হয়।
আরও শুনুন: সন্তানের স্মৃতিতেই বিয়ের উদ্যোগ যুগলের, নবদম্পতির ছবিতে দেখা মিলল ‘অশরীরী’ মেয়েরও
একইসঙ্গে এই সময়কাল বসন্ত ঋতুর। প্রকৃতির নিয়মমতোই এই সময় গাছপালা রঙিন হয়ে ওঠে। বলা বাহুল্য, ফাল্গুন পূর্ণিমা মানে একেবারে বসন্তের মাঝামাঝি সময়। তাই স্বাভাবিক ভাবেই প্রকৃতির রঙিন হওয়ার সঙ্গে মিশে যায় রঙের উৎসব দোল। অন্যদিকে রাধাকৃষ্ণের মিলনকে উদযাপন করে বাংলায় যেভাবে দোল উৎসব পালিত হয়, সেখানে রয়েছে প্রেমের অনুষঙ্গ। সবমিলিয়ে প্রকৃতি আর জীবজগতের প্রেমের মিলন উৎসব হিসেবেই ধরা দেয় দোল উৎসব।