তিনি পাহাড়ের দেবী। পাহাড়ের রানি। মাতারানি। বৈষ্ণদেবী। বিষ্ণুর সাধিকা, বিষ্ণুর প্রেমিকা, বাগদত্তা, বৈষ্ণবী। শ্রী বিষ্ণুর দেখা পাওয়ার আগে তাঁর ছিল অন্য নাম, অন্য পরিচয়। তিনি ছিলেন রত্নাকর সায়রের কন্যা ত্রিকূটা। সেখান থেকে কীভাবে হলেন বৈষ্ণবী? আপনাদের সেই গল্পই বলব আজ।
‘জয় মাতা দি’- এই ধ্বনি উঠলে প্রথমেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে সিংবাহিনী দেবীর মূর্তি। তবে প্রকৃত পক্ষে এই জয়ধ্বনি মাতা বৈষ্ণো দেবীর উদ্দেশেই নিবেদিত। এই ধ্বনি দিতে দিতেই ভক্তরা খাড়া পাহাড়ি পথ অতিক্রম করে গুহায় পৌঁছান। যদিও, পুরাণমতে তিনি দেবী দুর্গার অংশ নন। বরং তাঁর সঙ্গে যোগ আছে ভগবান রামচন্দ্রের। এমনকী যে পাহাড়ে এই দেবী মন্দির, সেই পাহাড়ের নামও হয়েছে দেবীর নাম অনুসারেই। এখন প্রশ্ন, বৈষ্ণোদেবীর নামের সঙ্গে কীভাবে যোগ রয়েছে ত্রিকূট পাহাড়ের? বা, শ্রী রামচন্দ্রের সঙ্গেই তাঁর যোগ ঠিক কেমন। সেই গল্পই শুনে নেব।
আরও শুনুন: বছরে দুবার পালিত হয় নবরাত্রি, কী ব্যাখ্যা শাস্ত্রের?
তখন ত্রেতাযুগ। বর্তমান দক্ষিণ ভারতের দক্ষিণ অংশে বসবাসকারী রত্নাকর সাগর ও তাঁর স্ত্রী নিঃস্তান ছিলেন। অনেক উপাসনার পর তাঁদের কোল আলো করে একসময় এক কন্যাসন্তান ত্রিকূটা জন্মগ্রহণ করে। ছোটবেলা থেকেই বহু সাত্ত্বিক গুণ তাঁর মধ্যে দেখা যায়। আর সে ছিল শ্রী রামের পরমভক্ত। একসময় জানা যায় ত্রিকূটা খুবই স্বল্পায়ু। মাত্র ৯ বছর বয়সেই তাঁর মৃত্যু হবে। তখন ত্রিকূটা তার আরাধ্য দেবতার উদ্দেশে ঘোর তপস্যা করতে শুরু করে। কথিত আছে শ্রীরামচন্দ্র লঙ্কায় যাওয়ার পথে, সাগরপাড়ে ধ্যানমগ্ন এক অদ্ভূত জ্যোতির্ময়ী বালিকাকে দেখতে পান। স্বয়ং শ্রী বিষ্ণুর অবতার অন্তর্যামী রামচন্দ্র জানতে পারেন যে সেই বালিকা তাঁরই ধ্যানে মগ্ন। আর কী কারণে সে ধ্যান করছে, তা বুঝতে পেরে রামচন্দ্রের ঠোঁটের কোণে সন্তুষ্টির হালকা হাসিও বুঝি দেখা গেল। এই বালিকাই ত্রিকূটা। তখন আর রামচন্দ্র নয়, ত্রিকালজ্ঞ স্বয়ং শ্রীবিষ্ণুর রূপে ত্রিকূটাকে দেখা দেন ভগবান। তাঁর ইচ্ছে জানতে চান। ত্রিকূটা তখন, বরস্বরূপ রামচন্দ্রকে স্বামী হিসেবে চেয়ে বসেন। ত্রিকূটা যে এই বর চাইবেন তা শ্রী রামচন্দ্র আগে থেকেই জানতেন। আর তিনিও খুশি মনে ত্রিকূটাকে বর প্রদান করবেন তাও ঠিক করেই রেখেছিলেন।
আরও শুনুন: আছে ‘পাপমোচন কুণ্ড’, বছরে একদিনই দর্শন মেলে কামাখ্যার বিশেষ শিবলিঙ্গের
অনেকেই বলবেন, কিন্তু রাম অবতারে শ্রী বিষ্ণু তো কেবলমাত্র সীতাকেই তাঁর পত্নী হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। তবে কি তা সম্পূর্ণ সত্যি নয়? রাম-সীতার জুটির আড়ালেও রয়েছে কোনও তৃতীয়জন? না, আসলে রামচন্দ্র ত্রিকূটার আরাধনায় খুশি হয়ে তাঁর ইচ্ছেপূরণ করতে চেয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু তা বলে সীতার প্রতি অবিচারও হতে দিতে পারেন না। তাই রামচন্দ্র ত্রিকূটাকে বলেন, সীতার প্রতি আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এ জন্মে আমি আর কাউকে নিজের স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করতে পারব না। তবে কলিযুগে তুমিই হবে আমার অর্ধাঙ্গিনী। ততদিন তুমি নির্জনে থেকে জগতের সকল জীবের কল্যাণ সাধন কর। সেই থেকে ত্রিকূটা, বিষ্ণুর সাধিকা, বিষ্ণুর প্রেমিকা, বৈষ্ণবী রূপে, সাধারণের নাগালের বাইরে লোকচক্ষুর আড়ালে, উত্তরের পর্বতমালার কোনও এক নির্জন গুহায় বসবাস শুরু করেন। আর বৈষ্ণবীর আবাসস্থল সেই পাহাড়ের নাম হয় ত্রিকূট পর্বত।
আরও শুনুন: হাওয়ার উলটোদিকে ওড়ে ধ্বজা, কম পড়ে না ভোগ, জগন্নাথ মন্দির ঘিরে আছে অলৌকিক রহস্য
কথিত আছে শ্রীধর নামের এক সাধক দেবীর এই গুপ্ত আস্তানা খুঁজে পান। এবং দেবীর পুজোর ব্যবস্থা করেন। বৌষ্ণোদেবীর মন্দির থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার খানেক দূরে রয়েছে ভৈরবঘাটি। যেখানে না গেলে বৈষ্ণোদেবী যাত্রা সম্পূর্ণ হয় না বলে ধরা হয়। এই ভৈরবনাথ ছিলেন একজন উপদেবতা মতান্তরে কাপালিক। যে একবার বৈষ্ণোদেবীর দেবত্ব খর্ব করার জন্য তাঁর সঙ্গে ঘোরতর যুদ্ধ শুরু করে। দেবীর কাছে যুদ্ধে হেরে মৃতপ্রায় ভৈরবের আত্মা অনুতপ্ত হয়। দেবী তখন তাঁকে ক্ষমা করে বরদান পূর্বক বলেন, আমার ভক্তদের যাত্রা সম্পূর্ণ হবে না যদি না তাঁরা তোমার দর্শন করে। এই বলে বৈষ্ণোদেবী, ভৈরবনাথের শিরোশ্ছেদ করে তাঁকে মুক্তি দেন। আর সেই শির আড়াই কিলোমিটার দূরে যেখানে গিয়ে পড়ে, সেখানে পরবর্তীকালে ভৈরবঘাটি মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশ-বিদেশ থেকে বহু ভক্ত কাটরা থেকে ১৪ কিলোমিটার, বিপদসঙ্কুল পাহাড়ি চড়াই রাস্তা পেরিয়ে আসেন একবার, বৈষ্ণোদেবীর দর্শন পেতে। বছর বছর নবরাত্রিতে কেমন গোটা ত্রিকূটপর্বত রাজপ্রাসাদের মত সেজে ওঠে, মাতারানির আবাহনে। এই মন্দিরে দেবী সরস্বতী, লক্ষ্মী ও কালীরূপ শিলা রূপে অবস্থান করেন।