তিনি শস্যের দেবী। আর তাই মা লক্ষ্মীর উপাসনা আমাদের চিরন্তন ঐতিহ্য। উপাসনা শুধু যে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা করেন, তা নয়। কৃষিপ্রধান বাংলায় অন্যান্য ধর্মের মানুষও প্রণত হন লক্ষ্মীদেবীর সামনে। আসুন শুনে নিই।
মা লক্ষ্মী ধনসম্পদের দেবী। তাই তাঁকে ধরে রাখার জন্য এত আয়োজন। কিন্তু জানেন কি, আদি বাংলায় লক্ষ্মীর ব্রত করা হত শস্যের কামনায়? আসলে প্রাচীন বাংলায় ধনসম্পদ মানেই জমি, তথা শস্য। শিল্প-বাণিজ্যের তখনও তেমন বিস্তার ঘটেনি, কৃষিই সেখানে অর্থ উপার্জনের উৎস। কোন দেবতা কোন অঞ্চলে পূজিত হবেন, তা আসলে অনেকখানিই নির্ভর করে সেই অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষিতের উপরে। সুতরাং লক্ষ্মী দেবীকে ধনদেবী বলে মনে করলে, তাঁর সঙ্গে শস্যের সম্পর্ক ওতপ্রোত। আর হয়তো সেই কারণেই, তাঁর পুজোয় বিভেদ সৃষ্টি করতে পারেনি ধর্মও। হিন্দু হোক কি মুসলমান, কৃষিজীবী বাঙালি একযোগে অর্চনা করে লক্ষ্মী দেবীর।
আরও শুনুন: মা লক্ষ্মীর অভিশাপেই মৃত্যু রাবণের, কেন অভিশপ্ত হয়েছিলেন লঙ্কেশ্বর?
সত্যি বলতে, দেবতাদের এমন মিলেমিশে থাকার নজির কিন্তু বাংলায় বিরল নয়। হিন্দুর সত্যনারায়ণ মুসলমান ঘরে পুজো পান ‘সত্যপীর’ রূপে। আবার সুন্দরবন অঞ্চলের বনবিবি আসলে বনদেবী, শোনা যায় এমন কথাও। বনের বিপদআপদে তাঁকে স্মরণ করেন হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সব বাঙালিই। হিন্দু বাঙালির লক্ষ্মী ঠাকুরও নাকি মুসলমান বাঙালির ঘরে ঠাঁই পেয়ে গিয়েছেন সামান্য নামের বদল করে। সেখানে তাঁর পরিচয় লক্ষ্মীবিবি। অবশ্য প্রত্যেক সপ্তাহের বৃহস্পতিবার তাঁর পুজো হয় না। মূলত যে মাসে নতুন ধান ঘরে আসে, সেই মাসেরই কোনও এক বৃহস্পতিবারে পুজো পান লক্ষ্মীবিবি। এই উপলক্ষে লক্ষ্মীর পাঁচালি গেয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে মাধুকরী করা হয়। গাওয়া হয়- “আইলাম রে অবনে/ লক্ষ্মীবিবির চরণে।/ লক্ষ্মীবিবি দিলা বর/ চাইল কড়ি বাইর কর।।” শিরনিও মানত করা হয় লক্ষ্মীবিবির উদ্দেশে। দেবীকে ভোগ হিসেবে দেওয়া হয় চিনি, কলা, মিষ্টি এবং চিতই পিঠে বা আস্কে পিঠে। এর সঙ্গে থাকে লক্ষ্মীপূজার সবচেয়ে চেনা দুটি উপকরণ, সিঁদুর ও দূর্বা।
আরও শুনুন: লক্ষ্মীকে বিয়ে করার জন্য ধার করেছিলেন বিষ্ণু, তিরুপতি মন্দিরে সেই ঋণ শোধ করেন ভক্তরা
নতুন ধান ওঠার মাসেই যেমন লক্ষ্মীবিবির উপাসনার সময় বেছে নেওয়া হয়, তেমনই সেদিন শস্যের গোলার উপরে ও নিচে কলাপাতায় পাঁচ জোড়া করে পিঠে রাখা নিয়ম। এমন আচার থেকেই আরও স্পষ্ট হয়ে যায়, আসলে শস্যের দেবী হিসেবেই উপাসনা করা হয় লক্ষ্মীর। তাঁর আশীর্বাদেই ফসল ভাল হবে, কিংবা দুটো পয়সার মুখ দেখা যাবে বলে আশায় বুক বাঁধে গরিব বাঙালিরা। ধর্মের বিভাজন ভুলে তাই হিন্দুদের মতোই দেবীর উপাসনা করেন অন্য ধর্মের মানুষও।