৫৬ ভোগ। জগন্নাথের ভোগের এই বিশাল আয়োজনের কথা সকলেই জানেন। ভাত, ডাল, পরমান্ন, মালপোয়া- কী নেই সেই আয়োজনে? কিন্তু স্রেফ ৫৬ রকমই কেন? তার বেশিও নয়, কমও নয়! কী কারণ এর নেপথ্যে? আসুন শুনে নিই।
তিনি জগতের পালনকর্তা। শ্রী বিষ্ণুর রূপবিশেষ। কথিত আছে, পুরীর শ্রীমন্দিরে ভগবান রোজ ভোজন সারেন। তাই সেই আয়োজন যে রাজকীয় হবে তা বলাই বাহুল্য! তবে জগন্নাথ ভোগ হিসেবে ৫৬টি পদ থাকার নেপথ্যে এক প্রচলিত কাহিনি রয়েছে।
আরও শুনুন: শ্রীমন্দিরে অপূর্ব লীলা, জগন্নাথের সঙ্গে কেন থাকেন দেবী বিমলা?
দশাবতারের বিভিন্ন রূপই প্রভু জগন্নাথের মধ্যে প্রকট। মন্দিরের বিভিন্ন জায়গায় বিষ্ণুর দশাবতারের মধ্যে জগন্নাথের ছবিও দেখা যায়। তবে জগন্নাথের ভোগের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণ বিশেষভাবে সম্পর্কিত। শোনা যায়, মা যশোদা কৃষ্ণকে অষ্টপ্রহর কিছু-না-কিছু খাওয়াতেন। সে সময় ব্রজধাম প্রায়শই বালক কৃষ্ণের লীলায় মেতে উঠত। এমনই একবার ইন্দ্রের রোষে গোটা গ্রামে শুরু হল প্রবল বৃষ্টি। ঘর-বাড়ি, গরু-বাছুর সব ভেসে যাওয়ার জোগাড়। এমন অবস্থায় কৃষ্ণ কি আর চুপ করে থাকতে পারেন! অলৌকিক কাণ্ড ঘটিয়ে সকলকে চমকে দেন তিনি। গোটা গোবর্ধন পর্বতটাই তুলে নেন নিজের কড়ে আঙুলে। ব্রজবাসী সেই পাহাড়ের নিচে আশ্রয় নেন। টানা এক সপ্তাহ ওইভাবেই তাঁদের রক্ষাকর্তা হিসেবে পাহাড় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন কৃষ্ণ। এদিকে যে ছেলে দিনে আটবার ভোজন করত, সে সাতদিন কিছু খাওয়ার সুযোগ পায়নি। এতে মা যশোদা খুবই উতলা হয়ে ওঠেন। ঠিক করেন সাত দিনে কৃষ্ণ যা যা খেত সেই সব একসঙ্গে তৈরি করে খাওয়াবেন। হিসাব অনুযায়ী ৮ বার করে সাতদিনের হিসাবে ৫৬ রকমের পদ হওয়ার কথা। মা যশোদা সেই ৫৬ রকম পদই কৃষ্ণের জন্য প্রস্তুত করেন। তাঁর সঙ্গে যোগ দেন ব্রজবাসীরাও। এদিকে ইন্দ্রও নিজের ভুল বুঝতে পেরে সাতদিন পর আবহাওয়া শান্ত করে দেন। গোর্বধন পর্বত নামিয়ে কৃষ্ণ সেই ৫৬ পদ ভোগ হিসেবে গ্রহণ করেন। মনে করা হয়, এর থেকে জগন্নাথের ৫৬ ভোগের প্রচলন।
আরও শুনুন: রথযাত্রায় জগন্নাথ যান গুণ্ডিচায়, সে সময় কি শূন্য থাকে শ্রীমন্দির?
কিন্তু এতরকম পদ তৈরি করা তো মুখের কথা নয়! তাই সকাল থেকে রাত অবধি ভোগের আয়োজন চলে শ্রীমন্দিরে। প্রায় ৭৫২টি উনুন জ্বলে সারাদিন। রান্নার কাজে নিযুক্ত থাকেন প্রায় ৪০০ জন। মূলত দু-ধরনের ভোগের ব্যবস্থা থাকে। ভাত, ডাল, পরমান্ন জাতীয় খাবার আর খই মুড়কি জাতীয় শুকনো খাবার। তবে ভাত আর ডাল দুটোই হয় পাঁচ রকমের। এছাড়াও থাকে শুক্তো, বেগুন মরিচপানি, বিভিন্ন রকমের তরকারি, পোলাও, নারকেলবাটা দিয়ে সুস্বাদু কিছু চাটনি জাতীয় পদ আর অবশ্যই পরমান্ন। এছাড়া জগন্নাথের ভোগ হিসেবে মালপোয়া খুবই জনপ্রিয়। অন্তত ৩ রকমের মালপোয়া নিবেদন করা হয় প্রভুকে। আর মিষ্টি তো রয়েছেই। রসের মিষ্টি, ছানার মিষ্টি, গজা, শুকনো মিষ্টি ইত্যাদি একাধিক রকমের পদ দিয়ে সাজানো হয় জগন্নাথের ৫৬ ভোগ। রান্নার পদ্ধতিও বেশ অদ্ভুত। একসঙ্গে সাতটি হাঁড়ি উপর উপর বসিয়ে রান্না হয়। আর আশ্চর্যের বিষয়, সবার উপরে থাকা হাঁড়িটিতেই আগে রান্না শেষ হয়। মূলত ফুটন্ত জলে সবজি এবং মশলা দিয়ে চলতে থাকে মহাপ্রভুর রান্না। তবে পেঁপে, আলু, টমেটো, কাঁচা লঙ্কা জাতীয় সবজি জগন্নাথের ভোগে ব্যবহার করা হয় না। বেশ কয়েক ধরনের শাকও প্রভুর ভোগে নিষিদ্ধ। এমনকি নুন, চিনি এবং তেলও সরাসরি ব্যবহার করা হয় না। পরিপূরক হিসেবে দেওয়া হয় ঘি কিংবা গুড়। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলতে থাকে ভোগ নিবেদনের প্রক্রিয়াও। একেবারে মধ্যরাতে ডাবের জল খেয়ে প্রভু ঘুমাতে যান।
আরও শুনুন: স্বয়ং বুদ্ধই কি নতুন রূপে এলেন প্রভু জগন্নাথ হয়ে! কী ব্যাখ্যা শাস্ত্রের?
কথিত আছে জগন্নাথের ভোগ দর্শনে দুর্ভোগ কাটে। তাই প্রতিদিন দেশ বিদেশের নানা প্রান্ত থেকে ভক্তরা ছুটে আসেন শ্রীমন্দিরের প্রসাদ গ্রহণ করতে। তবে যত ভক্তই আসুন না কেন, ভোগ কখনও বাড়তিও থাকে না, আবার কমও পড়ে না। এমনই অপার প্রভু জগন্নাথের লীলা।