দোলপূর্ণিমার দিনেই আবির্ভাব মহাপ্রভুর। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, তাঁহার প্রেমের সীম ছিল না। সাধু-পাপী, হিন্দু-মুসলমান, পবিত্র-অপবিত্র, বেশ্যা-পতিত, সকলেই তাঁহার প্রেমের ভাগী ছিল। সকলকেই তিনি দয়া করিতেন; ” শ্রীচৈতন্যের শিক্ষা এখনও আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখায়।
বাংলা ৮৯১ সনে, ১৪৮৫ খ্রিস্টাব্দে ফাল্গুন মাসে দোলপূর্ণিমার দিনই জন্ম নিয়েছিলেন শ্রীচৈতন্য। তিনি বাঙালির প্রথম গণনায়ক। প্রেমের যে মহামন্ত্র তিনি দান করেছিলেন, তা শুধু ভক্তি আন্দোলনকেই স্রোতস্বিনী করেনি; একই সঙ্গে প্রভাবিত করেছিল সমাজের বিন্যাস ও জনমানসকেও। ভেদাভেদে ক্লিষ্ট সমাজকে যেন মুক্তির বাণী দিয়েই তিনি বলে উঠেছিলেন,
মুচি যদি ভক্তি করি ডাকে কৃষ্ণ করে।
কোটি নমস্কার করি তাঁহার চরণে।।
এই আইডিয়া বা ধারণাই আদতে বৈপ্লবিক। ধর্ম ও সমাজের সংস্কারকে তিনি পৃথক কল্পনা করেননি। ফলত তাঁর ধারণা সেদিন আমূল পরিবর্তনের ডাক-ই হয়ে উঠেছিল। জাত-পাতের বিভেদে দীর্ণ, হিন্দু-মুসলমানে ক্রমশ ভাগ হতে থাকা সমাজ যেন সেদিন পরিত্রাণ পেয়েছিল তাঁর উদার আহ্বানে। কালের প্রয়োজনেই জ্ঞান ও প্রেমকে তিনি এক সুতোয় বাঁধতে পেরেছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ তাই বলেছিলেন, “চৈতন্যদেবের জ্ঞান সৌরজ্ঞান- জ্ঞান সূর্যের আলো। আবার তাঁর ভিতর ভক্তিচন্দ্রের শীতল আলোও ছিল। ব্রহ্মজ্ঞান, ভক্তিপ্রেম দুই-ই ছিল।” এই যে সমন্বয়, তা তাঁর জীবনের দর্শন। এবং সেই সূত্রেই আলোড়িত করেছিলেন সমাজকে। শ্রীচৈতন্যের জন্ম গ্রহণকালে। আক্ষরিক অর্থেই সেই সময় চন্দ্রগহণ চলছিল, বিবরণে জানা যায়,
চতুর্দিকে লোক ধায় গ্রহণ দেখিয়া।
গঙ্গাস্নানে হরি বলি যায়েন ধাইয়া।।
যার মুখে জন্মেও না বোলে হরিনাম।
সেই হরি বলি ধায় করি গঙ্গাস্নান।।
এরকম মুহূর্তেই তাঁর আবির্ভাব। তবে, এই ‘গ্রহণ’-এর তাৎপর্য আরও প্রসারিত বলেই মনে হয়। সেই সময়ের সমাজের দিকে তাকালেও গ্রহণের ছায়া স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যুবক অবস্থায় নিমাই পণ্ডিতের খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা ছিল গোটা নবদ্বীপ জুড়েই। তর্কে পারঙ্গম, বিদ্বান মানুষ। তবে, তাঁর ভাবান্তরের সূচনা বোধহয় যখন মায়ের কথা রাখতে যখন শ্রীহট্টে ঢাকাদক্ষিণ গ্রামে গেলেন। প্রাচীন কোনও কোনও গ্রন্থ জানায় যে, পদ্মা পার হয়ে ফরিদপুর, বিক্রমপুর, সুবর্ণগ্রাম ইত্যাদি অঞ্চল ঘুরতে ঘুরতে তিনি তাঁদের আদি নিবাসে পৌঁছেছিলেন। এই পর্বেই সেই সময়ের গ্রামসমাজের সঙ্গে তাঁর নিবিড় পরিচয়। মানুষের দুঃখ-দুর্দশা তিনি খেয়াল করেন। একই সঙ্গে বুঝতে পারেন, ধর্মের নামে কীভাবে অধর্ম চারিদিক ছেয়ে ফেলেছে। পতিত ও নিম্নশ্রেণির মানুষরা সেই জাঁতাকলে পড়ে যে নিতান্তই দুর্দশাগ্রস্ত, তা বুঝতে তাঁর বাকি থাকল না। মূলত এই পর্ব থেকেই তাঁর জীবনে পরিবর্তন যেন দ্রুত খাতে বইতে থাকে। কোনও একটি কারণকে নির্দিষ্ট করে চিহ্নিত হয়তো করা যায় না। তবে, পণ্ডিত নিমাই পরবর্তীকালে অনেকটাই যে বদলে গেলেন, তার সলতে পাকানোর পর্ব এটিকে বলা যায়। তর্ক, অধ্যাপনায় তিনি নিজেকে আর সীমাবদ্ধ রাখলেন না। ভক্তি আর ভক্তির সূত্রে সামাজিক সমন্বয়ের ধারণা তখন থেকেই তাঁকে ভাবিত করে তুলেছিল বলে অনুমান করা যায়। পরবর্তীকালে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য হয়ে হাতে-কলমে সেই কাজটিই করেছিলেন তিনি। স্বামী বিবেকানন্দ সংক্ষেপে চৈতন্যচরিত ব্যাখ্যা করে তাই জানিয়েছিলেন, “তিনি ন্যায়ের অধ্যাপক হইয়া বাগযুদ্ধে লোককে পরাস্ত করিতেন। ইহাই তিনি অতি বাল্যাবস্থা হইতে জীবনের উচ্চতম আদর্শ বলিয়া শিক্ষা করিয়াছিলেন। কোন মহাজনের কৃপায় এই ব্যক্তির সারাজীবন পরিবর্তিত হইয়া গেল। তখন তিনি বাদ-বিবাদ, তর্ক, ন্যায়ের অধ্যাপকতা সবই পরিত্যাগ করিলেন। জগতে যত বড় বড় ভক্তির আচার্য হইয়াছেন এই প্রেমোন্মত্ত চৈতন্য তাঁহাদের অন্যতম। তাঁহার ভক্তির তরঙ্গ বঙ্গদেশে প্রবাহিত হইয়া সকলের প্রণে শান্তি দিল। তাঁহার প্রেমের সীম ছিল না। সাধু-পাপী, হিন্দু-মুসলমান, পবিত্র-অপবিত্র, বেশ্যা-পতিত, সকলেই তাঁহার প্রেমের ভাগী ছিল। সকলকেই তিনি দয়া করিতেন; এবং যদিও তৎপ্রবর্তিত সম্প্রদায় ঘোরতর অবনতি প্রাপ্ত হইয়াছে (যেমন কাল প্রভাবে সবই অবনতি প্রাপ্ত হইয়া থাকে) তথাপি আজ পর্যন্ত উহা দরিদ্র, দুর্বল, জাতিতে, পতিত, কোন সমাজে যাহার স্থান নাই- এইরূপ সকল প্রত্তির আশ্রয়স্থল।”
শুধু বিল্পবের সূচনাই নয়, কোনও মতের বিরোধিতা কীভাবে করতে হবে, তার পাঠও দিয়েছিলেন শ্রীচৈতন্য। কাজীর ফরমানের বিরুদ্ধে তাঁর রুখে দাঁড়ানোর ঘটনা তো আমাদের জানা। প্রসঙ্গত আর-একটি ঘটনার দিকেও চোখ রাখা যায়। তখন সদ্য সন্ন্যাস নিয়ে নীলাচলে গিয়েছেন শ্রীচৈতন্য। রাজা প্রতাপরুদ্রের সভাপণ্ডিত তখন বাসুদেব সার্বভৌম। তিনি নবীন সন্ন্যাসীকে দেখে তাঁকে বেদান্তশাস্ত্র শিক্ষা দেওয়ার প্রস্তাব দিলেন। শ্রীচৈতন্য সানন্দে রাজিও হলেন। বাসুদেব সার্বভৌম সেকালের তাবড় পণ্ডিত, তাঁর কাছে বেদান্তের যুক্তি শুনতে তাঁর আপত্তি ছিল না। শুরু হল বেদান্তের ব্যাখ্যা শোনা। দিন সাতেক পরে বিস্মিত সার্বভৌম খেয়াল করলেন যে, নবীন সন্ন্যাসী কিছুই বলছেন না। আদৌ তিনি কিছু বুঝতে পারছেন তো? প্রশ্ন করলেন পণ্ডিত বাসুদেব সার্বভৌম। উত্তরে প্রায় চমকে দিয়ে শ্রীচৈতন্য জানিয়েছিলেন, সূত্রভাষ্য সবই তিনি বেশ বুঝতে পারছেন। তবে, পণ্ডিতের ব্যাখ্যা ঠিক মনে হচ্ছে না। দেশবিখ্যাত পণ্ডিতের কাছে নবীন সন্ন্যাসীর এমন কথা একেবারেই অপ্রত্যাশিত। তিনি রেগেও গেলেন বটে, তবে, শ্রীচৈতন্য একেবারে যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন, ব্যাখ্যায় ঠিক কোথায় গোলমাল। আচার্য শঙ্করের ব্যাসসূত্রে ব্রহ্মের দ্বিবিধভাবের কথাই বলা আছে। কিন্তু পণ্ডিতের ব্যাখ্যা যেন সূত্রের সেই অর্থ আড়াল করে নিজের মতটাই জোর দিয়ে প্রকাশ করছে। সার্বভৌম ছাড়ার পাত্র ছিলেন না। শ্রীচৈতন্য নিজেও পণ্ডিত, একদা তর্কে বহু বিদ্বানকেই পরাস্ত করেছেন। অতএব দুই পণ্ডিতে বাধল তর্কযুদ্ধ। যুক্তি, প্রতিযুক্তির বন্যা বইল। তবে শেষ পর্যন্ত, চৈতন্যের যুক্তির কাছে পরাজয় স্বীকার করেছিলেন পণ্ডিতপ্রবর বাসুদেব সার্বভৌম।
দুটি বিষয় এই ঘটনা থেকে স্পষ্ট হয়। যেখানে যেটি বলা প্রয়োজন, তা যুক্তি সহকারে বলা দরকার। না-বলার মধ্যে আলাদা কোনও গৌরব নেই। সেই সঙ্গে, বিরোধিতা যদি করতেই হয়, তবে তাঁর যুক্তি পাকা হওয়া চাই। এই একই কথা বলেন আজকের চিন্তাবিদরাও। অমর্ত্য সেন এক বক্তৃতায় জানিয়েছিলেন, বিরোধিতার ক্ষেত্রে যুক্তির জোরের কথা। বিরোধিতার নিজস্ব ভাষা তখনই গড়ে ওঠে যখন তার অবলম্বন হয় স্পষ্ট জ্ঞান ও যুক্তির কাঠামো। আজকের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বিরোধিতার নামে যে ব্যক্তিআক্রমণ বা কুৎসা চলে, তা আদতে বিরোধিতাকেই লঘু করে তোলে। সেই সেকালে স্বয়ং শ্রীচৈতন্য বিরোধিতার স্বরূপটি স্পষ্ট করেই দিয়ে গিয়েছিলেন। প্রেম-ভক্তির মতো আচার্যের এই শিক্ষা আমাদের অগ্রগতিরই পথ দেখায়, আজও।