ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলেছেন, যত মত তত পথ। এই একটি কথার মধ্যেই যেন ভারতবর্ষের হাজার বছরের ধর্মতত্ত্ব লীন হয়ে আছে। এমন উদার সমন্বয়ের কথা জগতে আর দ্বিতীয়টি নেই।
হাজার হাজার বছর ধরে চলেছে ভারতের ধর্মচর্চা। নানা তত্ত্ব নানা মতের পথিকরা এসে জলসিঞ্চন করেছেন এই স্রোতে। সেই সমূহ জ্ঞানরাশির, সেই শাশ্বত উপলব্ধির সারাৎসার যদি কোথাও ধরা দেয়, তবে তা ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ-এর কথাতেই মেলে। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘শ্রীরামকৃষ্ণ ভারতবর্ষের সমগ্র অতীত ধর্মচিন্তার সাকার বিগ্রহস্বরূপ। যে তাঁকে নমস্কার করবে সে সেই মুহূর্তেই সোনা হয়ে যাবে।’ এ তো শুধু গুরুর প্রতি তাঁর ভক্তিচন্দন মাখা প্রণতি নয়, এ আসলে এক মনীষীর সম্পর্কে মনীষীর অনুভব। যে মহাসাধক আধুনিক জীবনের সার্থকতম মন্ত্রটি উচ্চারণ করে গিয়েছেন, জগৎবাসীকে শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছেন- যত মত তত পথ – তাঁর উদ্দেশেই তো এ-কথা বলা যায়।গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছিলেন,
যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্৷
মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশঃ৷
অর্থাৎ, যে আমাকে যেভাবে ভজনা করে, আমিও তাকে সেভাবেই কৃপা করি। মানুষ যে-পথই অনুসরণ করুন না কেন, আমার কাছেই এসে পৌঁছায়। সেই গীতার বাণীরই তো প্রতিধ্বনী শুনি শ্রীরামকৃষ্ণের কথায়। তিনি বলেন, যত মত তত পথ। যদি ভুল পথেও কেউ যায়, যদি ভুল করে ঘুরপথ ধরেও ফেলে, অন্তর যদি অসরল না হয়, তব সব পথই সোজা হবে। এসে পৌঁছাবে ঈশ্বরের কাছে।
আরও শুনুন : Spiritual: শাস্ত্রমতে কে আসলে প্রকৃত ধার্মিক? কী তাঁর নিত্যকর্তব্য?
আমাদের ধর্মচিন্তার অতীতের দিকে যদি আমরা যোখ মেলি, তবে দেখব, বিভিন্ন সময় কত না মত এসেছে এই ভূমিতে। সেই মতের পথিকদের মধ্যে পারস্পরিক বিরোধিতাও ছিল। ক্রমে ক্রমে এসেছে নানা ধর্মের বিভাজন। নানা সম্প্রদায়ের মধ্যে চলেছে বহু চাপানউতোর। আর এই সবকিছু অতিক্রম করে শ্রীরামকৃষ্ণ আমাদের দিলেন সহজতম শিক্ষা। শুধু কথার কথায় নয়। নানা পথ ধরে সাধনা করলেন নিজে। সিদ্ধিলাভ করে আমাদের শোনালেন মূল কথাটি। বললেন, সব পথ দিয়েই তিনি একবার করে হেঁটে এসেছেন। হিন্দু মুসলাম খ্রিস্টান আবার শাক্ত বৈষ্ণব বেদান্ত – সব পথেই সাধন করেছেন তিনি। আর শেষে দেখেছেন, সব পথের শেষেই একই ঈশ্বরের অধিষ্ঠান। পথ ভিন্ন হলেও সবাই এসে পৌঁছচ্ছেন একই বিন্দুতে। এ যেন সেই, সব পথ এসে মিলে গেল শেষে তোমারই দুখানি নয়নে… সেই পরমে মিলে যাওয়ারই শাশ্বত সত্যটি আমাদের একটি মাত্র একটি কথাতেই বুঝিয়ে দিলেন ঠাকুর।
প্রকৃত জ্ঞানী যিনি তিনি এই কথাটিই তো সবার আগে উপলব্ধি করেন। যিনি ভেদাভেদ করেন, তাঁর জ্ঞানচক্ষুর উন্মীলন হয়নি। আর যাঁর চোখ ফুটেছে, তার কাছে কোনও একরকম নয়, বরং সবরকমেরই জ্ঞান থাকে। তাই তো দেখি একদিন ভক্ত কেশবকে ডেকে ঠাকুর বলছেন, যার পুরুষ জ্ঞান আছে তার মেয়ে জ্ঞানও আছে। যার বাপ জ্ঞান আছে, তার মা জ্ঞানও আছে। যার রাত জ্ঞান আছে তার দিন জ্ঞান আছে, যার অন্ধকার জ্ঞান আছে তার আলো জ্ঞানও আছে। ঠাকুরের মুখের কথা শুনে কেশব হেসে বললেন, বুঝেছি। ঠাকুর তখন আরও বললেন, দুধ কেমন? না ধোবো ধোবো। দুধকে ছেড়ে দুধের ধবলত্ব বোঝা যায় না। তাই ব্রহ্মকে ছেড়ে শক্তিকে আবার শক্তিকে ছেড়ে ব্রহ্মকেও বোঝা যায় না। নিত্যকে ছেড়ে যেমন বোঝা যায় না লীলাকে আবার লীলা ব্যতিরেকে নিত্যের উপলব্ধিও অসম্ভব।
সাকার-নিরাকার, দ্বৈত-অদ্বৈত, ব্রহ্ম-শক্তি নিয়ে যত তর্ক উত্থাপিত হয়, ঠাকুর এইভাবেই তার সমাধান করে দিলেন নিমেষে। অবশ্য এ নিয়ে ঠাকুরকে কম ভোগান্তি সইতে হয়নি। স্বয়ং ঠাকুর যাঁর কাছে বেদান্ত সাধনার দীক্ষা নিয়েছিলেন, শোনা যায়, সেই শ্রীমৎ তোতাপুরীরই ঠাকুরের ভক্তিপথের ঘোর বিরোধী ছিলেন। ঠাকুর যখন দুই হাতে করতালি দিয়ে হরিনাম করতেন, দেখে পুরীজী মশকরা করতেন। এইভাবেই চলছিল। ঠাকুর যতই বোঝান, পুরীজি ততই অনড়। একদিন হঠাৎ তোতাপুরী কঠিন রোগে আক্রান্ত হলেন। শরীরে অসম্ভব জ্বালা-যন্ত্রণা। নিজের মনও আর তখন নিজের বশে থাকছে না। বিরক্ত হয়ে তিনি ঠিক করলেন, যে শরীর এত যন্ত্রণার উৎস সেটিকে তিনি গঙ্গায় বিসর্জন দেবেন। মনস্থির করে তিনি তো নামলেন জলে। কিন্তু যতই জলের গভীরে এগোতে থাকেন, দেখেন ডুব দেওয়া আর সম্ভব হচ্ছে না। জল যেন আর কিছুতেই জানু ছাড়ায় না। ক্রমে ক্রমে একসময় তিনি এপার ছেড়ে ওপারে পৌঁছে গেলেন। সেইদিন অকস্মাৎ তার ভিতর থেকে সরে গেল যেন একখানা পর্দা। ভেদবুদ্ধির যে আবরণ তিনি এতদিন লালন করেছেন, তা খসে পড়ল এক নিমেষে। তিনি উপলব্ধি করলেন, জলে স্থলে শরীরে যেদিকেই চোখ যায় একজনেরই উপস্থিতি। তিনি ব্রহ্মশক্তি – মা।
পরদিন সকালে ঠাকুর যখন গুরুর শরীরের খোঁজ নিতে এলেন, তোতাপুরীর চোখমুখ তখন আনন্দে উদ্ভাসিত। আর বিন্দুমাত্র জ্বালা-যন্ত্রণার অনুভব নেই তাঁর। ঠাকুরকে তিনি বললেন, তিনি সেই আনন্দময়ীর দর্শন পেয়েছেন। তাঁর শরীর এখন যন্ত্রণামুক্ত হয়েছে। ঠাকুর হাসতে হাসতে জবাব দিলেন, ‘মাকে যে আগে মানতে না, শক্তি মিথ্যা ঝুটা বলে আমার সঙ্গে তর্ক করতে, এখন তো দেখলে, চক্ষু কর্ণের বিবাদ ঘুচে গেল।’ ঠাকুর তাই বলেন, ব্রহ্ম ও শক্তি একই, অভেদ। আগুন আর আগুনের দাহিকা শক্তি যেমন পৃথক নয়, ঠিক তেমনই।
আরও শুনুন : Spiritual: জগন্নাথ বিগ্রহের কী ব্যাখ্যা আছে শাস্ত্রে?
এই উদার ধর্মমতই আমাদের আজীবনের ধর্মচিন্তার সারাৎসার। গীতায় শ্রী কৃষ্ণ যে বলছেন, সব পথ এসে তাঁর কাছেই মিলছে, আমাদের প্রেমময় ঠাকুরও সেই কথাটিই বলছেন। আজ ধর্ম নিয়ে, মত নিয়ে যত বিভাজনই আমরা ভ্রমবশে করে ফেলি না কেন, ঈশ্বরেরর পৌঁছনোর আসল কথাটি কিন্তু এই সমন্বয়, এই উদারতার ভিতরই নিহিত।