বিষয়বাসনা থেকে কামিনীকাঞ্চন – এই সংসারের জালে বাঁধা পড়ে কষ্টের আর শেষ নেই। মহাপুরুষ যাঁরা, তাঁরা তো প্রায়শই বলেন সংসারের নানা বন্ধন অতিক্রম করার কথা। কিন্তু কথাটা হল সংসারে যদি এতই কষ্ট, এতই বাধা, তবে ঈশ্বর রেখেছেন কেন?
এ সংসার মায়াময়। এ কথা কে না জানে! সংসারের মায়ায় আমরা ঈশ্বরলাভের পথ থেকে সরে সরে যাই। মহাপুরুষগণ এ ব্যাপারে আমাদের কত না সচেতন করেছেন! এখান থেকে ভক্তমনে প্রশ্ন জাগে, এত যদি কষ্ট, এতই যদি বাঁধনের যন্ত্রণা, তাহলে ঈশ্বর তাঁর সন্তানকে অর্থাৎ মানুষকে এই সংসারে রেখেছেন কেন?
এক ভক্ত একবার এই প্রশ্ন করলেন ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণকে। বললেন, ঠাকুর, সংসার তিনি কেন রেখেছেন? ঠাকুর বললেন, ‘সৃষ্টির জন্য রেখেছেন। তাঁর ইচ্ছে। তাঁর মায়া। কামিনী কাঞ্চন দিয়ে তিনি ভুলিয়ে রেখেছেন।’
ভক্তমনে আবার প্রশ্ন জাগে। ভক্ত বলেন- ঈশ্বর, ভুলিয়ে রেখেছেন কেন? ঠাকুর জবাব দেন, ‘তিনি যদি ঈশ্বরের আনন্দ একবার দেন, তাহলে আর কেউ সংসার করে না। সৃষ্টিও চলে না।’
আরও শুনুন: Spiritual : মন থেকে চঞ্চলতা দূর করে নিজেকে পবিত্র ও সংযত করবেন কীভাবে?
এরপর ঠাকুর শোনালেন একখানা গল্প। বললেন, ‘চালের আড়তে বড় বড় ঠেকের ভিতরে চাল থাকে। পাছে ইঁদুরগুলো ওই চালের সন্ধান পায়, তাই দোকানদারে একটা কুলোতে খই-মুড়কি রেখে দেয়। ওই খই-মুড়কি মিষ্টি লাগে, তাই ইঁদুরগুলোক সমস্ত রাত কড়র মড়র করে খায়। চালের সন্ধান আর করে না। কিন্তু দেখো একসের চালে চৌদ্দগুণ খই হয়। কামিনী কাঞ্চনের আনন্দ অপেক্ষা ঈশ্বরের আনন্দ কত বেশি। তাঁর রূপ চিন্তা করলে রম্ভা-তিলোত্তমার রূপ চিতার ভস্ম বলে বোধ হয়।”
কী সুন্দর করে ঠাকুর বুঝিয়ে দিলেন এই সংসারে থাকার কথা। ঈশ্বরের ইচ্ছেতেই থাকতে হয় সংসারে। কিন্তু সেই সংসারে কেমন করে থাকতে হবে, তাও শিখিয়ে দিলেন ঠাকুর। মুড়-মুড়কি খোঁজ নাকি চালের সন্ধান করতে হবে, সেইটেই আসল কথা। আসলে ঠাকুর বললেন, ঈশ্বরের জন্য ব্যাকুল হতে হবে।
আরও শুনুন: Spiritual: দানের কথা বলেন মহাপুরুষগণ, কীরকম দানে পুণ্য লাভ হয়?
ভক্ত তখন প্রশ্ন করেন, সংসারে থাকতে থাকতে ঈশ্বরের জন্য ব্যাকুলতা হয় না কেন?
ঠাকুর তাঁকে বুঝিয়ে বললেন, ‘ভোগান্ত না হলে ব্যাকুলতা হয় না। কামিনী-কাঞ্চনের ভোগ যেটুকু আছে সেটুকু তৃপ্তি না হলে জগতের মাকে মনে পড়ে না। ছেলে যখন খেলায় মত্ত হয়, তখন মাকে চায় না। খেলা সাঙ্গ হয়ে গেলে তখন বলে, ‘মা যাব’। হৃদের ছেলে পায়রা নিয়ে খেলা করছিল; পায়রাকে ডাকছে, ‘আয় তি তি’। পায়রা নিয়ে খেলার তৃপ্তি যেই হল, অমনি কাঁদতে আরম্ভ করলে। তখন একজন অচেনা লোক এসে বললে, আমি তোকে মার কাছে নিয়ে যাচ্ছি আয়। সে তারই কাঁধে চড়ে অনায়াসে গেল। যারা নিত্যসিদ্ধ তাঁদের সংসারে ঢুকতে হয় না। তাঁদের ভোগের বাসনা জন্ম থেকেই মিটে গেছে।’
এই হল ঠাকুরের কথা অর্থাৎ কথামৃত। ঠাকুর যেমন বুঝিয়ে দিলেন সংসারে থাকার কারণ, তেমনই শিখিয়ে দিলেন এই সংসার রূপ খেলা থেকে কীভাবে জগতের মায়ের কাছে ফিরে যেতে হয়, সেই কথাটিও। তাই তো তিনি প্রেমময়, করুণাঘন। আমরা বারেবারে তাই তাঁর কথাই স্মরণ করি, শরণ নিই তাঁর।