কখনও কখনও শোক আমাদের বশীভূত করে ফেলে। আমরা শোকের পীড়নে এমন অবশ হয়ে যাই যে, জগতের প্রকৃত সত্য থেকেই সরে যাই অনেক দূরে। তখন শোকই আমাদের কাছে সত্যি হয়ে দাঁড়ায়। অথচ জ্ঞানীজনেরা বলেন, মনের দরজা-জানলা গুলো যদি খুলে রাখি তাহলেই আমরা পেয়ে যাব শোক অতিক্রমের মন্ত্র। শোনাচ্ছেন সতীনাথ মুখোপাধ্যায়।
তোমার অমল অমৃত পড়িছে ঝরিয়া।
দিকে দিকে আজি টুটিয়া সকল বন্ধ
মুরতি ধরিয়া জাগিয়া ওঠে আনন্দ;
জীবন উঠিল নিবিড় সুধায় ভরিয়া।
রবি ঠাকুরের এই পঙ্ক্তি কটা দিয়েই শুরু করলাম। আসলে আমরা তাঁরই জীবনের একটি ঘটনার প্রসঙ্গেই আসব। সেবার কবি ফিরছেন শান্তিনিকেতন থেকে। তার দিনকয় আগেই চলে গিয়েছেন কবির প্রাণপ্রিয় পুত্র শমীন্দ্রনাথ। শমীর মৃত্যুতে কবির মন বিষাদে পরিপূর্ণ। জীবনে মৃত্যু তিনি কম দেখেননি। মা, বাবা, প্রিয় বৌঠান থেকে শুরু করে স্ত্রী এমনকী নিজের মেয়েরও মৃত্যু দেখেছেন। মৃত্যুর এই কালো অন্ধকারময় প্রচ্ছদপটের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছে বহুবারই। কখনও তিনি নিজের শান্ত, সৌম্য ঘেরাটোপ ছেড়ে বেরিয়ে আসেননি। সমস্ত দুঃখের দহনকে তিনি বরাবর সৃষ্টির আনন্দেই রূপান্তরিত করেছেন। সেই তিনিও এবার যেন একটু বেশিই বিচলিত। শমী ছিল তাঁর বড় আদরের ধন। তাই বোধহয় অন্তরের দহন খানিক বেশি।
আরও শুনুন: Spiritual: উপবাসেই কি প্রার্থনায় সাড়া দেন ভগবান?
সেদিন রেলগাড়িতে বসে রাতে কবি দেখলেন সারা চরাচর ভেসে যাচ্ছে জ্যোৎস্নায়। আচমকাই তাঁর মনে হল, কই প্রকৃতিতে তো কোথাও কিছু কম পড়েনি। তাঁর আত্মীয়বিচ্ছেদ হয়েছে, তাঁর মন বিষাদে তিক্ত, কিন্তু সেই কারণে এই মহাবিশ্বচরাচর তো বিন্দুমাত্র ভাবিত নয়। সেখানে তো আজও একইরকম ফুটেছে জ্যোৎস্না। যেন সাদা ফুলে ছেয়ে গেছে চরাচর। আসলে এই যে যাওয়া-আসা, এই যে থাকা বা না-থাকা সে তো কেবল সাময়িক অনুভব মাত্র। তা নিত্য নয়, চরম সত্য নয়। প্রকৃতিতে কিছুই ফুরোয়নি, তাই কিছু কম পড়েনি তার আনন্দ আয়োজনে। কবির মন এবার শান্ত হল। প্রাণভরে তিনি দেখলেন, উপলব্ধি করলেন সেই পরমেরই অমল অমৃত ঝরে পড়ছে এই পৃথিবীতে। সেখানে ক্ষয় নেই, মৃত্যু নেই, বিষাদ নেই।
আরও শুনুন – Spiritual: কথামৃত শ্রবণে কেন মঙ্গল হয় মানুষের?
আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু বিরহ দহন লাগে, তবু শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে… এই তো ঋষিকবির সার্থকতম অনুভব।
বহু জ্ঞানীজনও শোকে এমন কাতর হয়ে পড়েন যে, তা অতিক্রমের শক্তি যেন পান না। বিচ্ছেদের যন্ত্রণা আমাদের অনঃকরণ খায় কুরে কুরে। কিন্তু আমাদের দর্শন, আমাদের শাত্র বলে সেই একই কথা। বলে যে, কিছুই ফুরিয়ে যায় না। কিছুই শেষ হয়ে যায় না।
শ্রী গীতা বলেন,
নাসতো বিদ্যতে ভাবো নাভাবো বিদ্যতে সতঃ।
অর্থাৎ, যা নেই তা হতে পারে না, আর যা আছে তার অভাব হয় না। কোনও কিছুই নতুন উৎপন্ন যেমন হয় না, তেমন বিনষ্টও হয় না। সবকিছুরই পরিবর্তন হয় মাত্র।
বাকি অংশ শুনে নিন প্লে-বাটন ক্লিক করে।