ঠাকুরের দিকে তাকিয়ে তখন বিস্ময়ের ঘোর কাটছে না যুবক নরেন্দ্রনাথ! দক্ষিণেশ্বরের এই ঠাকুর তাঁকে কী বলছেন? কেনই বা বলছেন? নরেন্দ্রনাথের যুক্তি-বুদ্ধি যেন গঙ্গার স্রোতে ভেসে যায় যায়! ঠাকুর ইতিমধ্যে তাঁর সামনে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। যেন নরেন্দ্রনাথ দেবতার মূর্তি। আর ঠাকুর তাঁর ভক্ত। সেইভাবে দাঁড়িয়ে ঠাকুর উচ্চারণ করলেন সেই অমোঘ কথাটি; বললেন, ‘জানি আমি প্রভু, তুমি সেই পুরাতন ঋষি, নররূপী নারায়ণ, জীবের দুর্গতি নিবারণ করিতে পুনরায় শরীরধারণ করিয়াছ’।
সে এক হেমন্তের শেষবেলা। এই পৃথিবীতে অকস্মাৎ ঘটে গেল এক আশ্চর্য ঘটনা। অকস্মাৎ বলছি বটে, তবে সত্যিই কি আর তা অকস্মাৎ! না, তা নয়। বরং আবহমানের পথে একদিন না একদিন তো দেখা দিতই এ মুহূর্ত। দেখা হয়ে যেত তাঁদের দুজনের। আর পৃথিবী পেত এক অনন্ত অমৃতধারার সাক্ষাৎ। যে অমৃতের পুণ্য-স্পর্শে ধন্য হবে ধরাতল। ধর্ম আর মানুষের মহাবন্ধন নতুন করে হবে প্রতিষ্ঠিত। পৃথিবীর সাল-তারিখের হিসাবে সে মুহূর্তকে বাঁধা যায় না। তবু ক্যালেন্ডারের হিসাবে সেটা ছিল ১২৮৮ বঙ্গাব্দ, ইংরাজির ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দ। নভেম্বর মাস। প্রথম দেখা হল ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও নরেন্দ্রনাথ দত্তের।
ঠাকুর জানতেন, তাঁরা সব একে একে আসবে। তাঁদের যে আসতেই হবে। এই পৃথিবীতে যখন যখন তাঁদের দরকার পড়েছে, একে একে তাঁরা এসেছেন। করেছেন জগতের মঙ্গলসাধন। আবারও আসবেন তাঁরা। ধরাধামে নেমে আসবেন উচ্চশ্রেণির সাধকসকল। আর আসবেন সেই বিশেষ একজন। পদ্মমধ্যে যিনি সহস্রদল। তাঁর জন্যই তো আসরখানা সাজিয়ে গুজিয়ে একা অপেক্ষা করছেন ঠাকুর। দেখছেন, চারিদকে কত না মতের বিভেদ! শুধুই ‘আমি’র প্রকাশ। সাধনার পথে পথে সহস্র দ্বন্দ্ব। প্রতি পথ নিজেকে সেরা প্রমাণে ব্যস্ত। ঠাকুর দেখছেন সবই। আর ধীরে ধীরে তৈরি করছেন ক্ষেত্র। আগে তো আবহ সম্পূর্ণ হোক। তবে তো লীলার প্রকাশ। আর সে লীলা যে সেই সহস্রদল পদ্মটিকে ছাড়া সম্পূর্ণ হবে না। ঠাকুর বসে আছেন, আর যেন ভাবছেন- আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর তোমার প্রেম হত যে মিছে। এ জগতকে যিনি পঙ্কিলতা থেকে উদ্ধার করবেন, মুক্তি দেবেন জঙ্গমতা থেকে, তাঁর জন্যই অপেক্ষা ঠাকুরের। তাঁর নিজের লীলাও যে তাঁকে ছাড়া সম্পূর্ণ হবে না।
আরও শুনুন: কেন ভক্তের কাছে নিজেকে লুকিয়ে রাখেন ঈশ্বর?
প্রদীপ জ্বলে ওঠার আগে একটু একটু করে চলছিল সলতে পাকানর পর্বটি। মহাকাল ছাড়া আর কেউই যেন টের পায়নি কিচ্ছুটি। দক্ষিণেশ্বরের ঠাকুরের নাম তখন ছড়িয়ে পড়েছে। একদিন সিমলার সুরেন্দ্রনাথ মিত্র গিয়ে ঠাকুরকে দর্শন করলেন। অন্তরে এল অপূর্ব প্রশান্তি। খুব ইচ্ছে, ঠাকুরকে একবার তাঁর বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার। আর কী আশ্চর্য, ঠাকুরকে সে কথা বলতে তিনিও শিশুর আনন্দে রাজি হয়ে গেলেন। কথামতো ঠাকুর এলেন তাঁর বাড়িতে। এদিকে ঠাকুরকে য গান শোনাতে হবে। কে গান শোনাবে? প্রতিবেশী যুবক নরেন্দ্রনাথকেই আহ্বান জানালেন তিনি। এই সেই আশ্চর্য মুহূর্ত। ঠাকুরকে গান শোনাতে এলেন নরেন্দ্রনাথ। আর দেখা হয়ে গেল দুই যুগপুরুষের।
আরও শুনুন: সমস্ত কর্ম ঈশ্বরে অর্পণ করে প্রাত্যহিক জীবনযাপন করবেন কী করে?
যুবক নরেন্দ্রনাথ তখন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এফ এ পরীক্ষা দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। বাংলা গান দু-একটাই জানেন। সেদিন শোনালেন একখানা ভজন। গান গাইছেন যুবক, আর মনে মনে উৎফুল্ল হয়ে উঠছেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তিনি যুবকের বিষয়ে কত কী জেনে নিচ্ছেন। অঙ্গপরীক্ষা করে মিলিয়ে নিচ্ছেন চিহ্নসমূহ। তাঁর মন বলছে, এসেছেন, তিনি এসেছেন। কে তিনি? আর কেউ না জানুক, ঠাকুর তো তাঁকে জানেন। ঠাকুরকে যে তিনি কথা দিয়েছিলেন যে, তিনি আসবেন। সমাধির ভিতর তাঁর দর্শন পেয়েছিলেন ঠাকুর। মন যত জ্যোতির্ময় ক্ষেত্রে আরোহণ করছে, ঠাকুর দেখছেন, তিনি পেরিয়ে যাচ্ছেন চন্দ্র-সূর্যের স্থূল জগৎ। প্রবেশ করছেন সূক্ষ্ম ভাবজগতে। সেই রাজ্য ধরে এগোতে এগোতে ঠাকুর দেখছেন পথের দুপাশে দেবদেবীদের ভাবঘন মূর্তি। অনেকটা পথ পেরিয়ে এসে দেখলেন সেই রাজ্যের চরম সীমায় যেন একখানি বেড়া দেওয়া আছে। জ্যোতির্ময় সেই ব্যবধান। তার এদিকে খণ্ড, অন্যদিকে অখণ্ডের সংসার। ঠাকুরের মন এবার সেই ব্যবধান অতিক্রম করে প্রবেশ করল নতুন রাজ্যে। এ এমন রাজ্যে যেখানে দেবদেবীরাও প্রবেশ করতে পারেন না। তাঁরা অনেকটা নিচে নিজেদের অধিকার বিস্তৃত করে আছেন। তাহলে অখণ্ডের রাজ্যে আছেনটা কে? কৌতূহলে এগিয়ে যাচ্ছে ঠাকুরের মন। আর সন্ধান পাচ্ছে এক অপূর্ব দৃশ্যের। দেখলেন, দিব্যজ্যোতি ঘনতনু সাতজন ঋষি সেখানে আছেন। প্রেমে-পুণ্যে-ত্যাগে তাঁরা এতটাই উচ্চ মার্গে অবস্থান করছেন যে, দেবদেবীদেরও ছাড়িয়ে গিয়েছেন। বিস্মিত ঠাকুর। এই ঋষিদের মহত্ত্বের কথা চিন্তা করছেন। এমন সময় সেই জ্যোতির্মণ্ডলের একটা অংশ ঘনীভূত হয়ে একজন দিব্যশিশুর রূপ নিল। ঠাকুর দেখছেন, সেই দেব-শিশু একজন ঋষির কাছে গিয়ে উপস্থিত হল। তাঁর কোমল হাত দুটি দিয়ে জড়িয়ে ধরল সেই ঋষির গলা। তারপর ঋষির সমাধি ভাঙার চেষ্টা করতে লাগল। বালকের কণ্ঠস্বর শুনে সমাধির বহু উচ স্তর থেকে যেন নেমে এলেন ঋষিপ্রবর। অর্ধস্তিমিত নয়নে সেই বালককে দেখতে লাগলেন। তাঁর মুখে ফুটে উঠল প্রসন্ন আলো। যেন তাঁরা একে অন্যকে বহুকাল থেকে চেনেন। সেই অদ্ভুত দেব-শিশু তখন আনন্দে বলে উঠল, ‘আমি যাচ্ছি, তোমাকেও আমার সঙ্গে যেতে হবে’। ঋষি শিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মুখে কিছু বললেন না। কিন্তু তাঁর দুই চোখে ফুটে উঠল সম্মতি। ঠাকুর দেখলেন, একটু পরেই ঋষির শরীর-মনের একাংশ জ্যোতির আকার ধারণ করে ধরাধামের প্রতি নেমে যাচ্ছে। ঠাকুর জানেন, সেই শিশু তিনি স্বয়ং। আর সেই ঋষিপ্রবর? সেদিন সুরেন্দ্রনাথের বাড়িতে প্রথম দর্শনেই ঠাকুর চিনে ফেললেন তাঁকে।
আরও শুনুন: এই জীবনের কর্মফল মানুষকে এই জন্মেই ভোগ করতে হয়
এদিকে নরেন্দ্রনাথের এফ এ পরীক্ষা শেষ হল। বিয়ে করতে তিনি রাজি নন। সংসার নয়, হেথা নয় হোথা নয় অন্য কোথা, অন্য কোনোখানে যেন তাঁর গন্তব্য। যুবক নরেন্দ্রনাথ চাতকের মতো সেই দর্শনের অপেক্ষা করতে থাকেন। কিন্তু কার দর্শন? সেটাই যেন ঠিক বোঝা যায় না। তত্ত্ব পড়েছেন ঢের! শাস্ত্র পড়েছেন খুঁটিয়ে। ব্রাহ্মসমাজে যাতায়াত আছে। কিন্তু শান্তি কোথায়! একদিন বাবা বিশ্বনাথ দত্ত বললেন, যদি ধর্মেই মন থাকে তাহলে এখানে সেখানে না ঘুরে দক্ষিণেশ্বরে যাও। চমকে উঠলেন নরেন্দ্রনাথ। প্রতিবেশী সুরেন্দ্রনাথও তাঁকে দক্ষিণেশ্বরে যাওয়ার কথা বলছিলেন। আর অনুরোধ করেছিলেন সেই মানুষটা। সেই একদিন কয়েক মুহূর্তের জন্যই তো তাঁকে দেখা। কিন্তু সকলেই এত করে দক্ষিণেশ্বরে যেতে বলছে কেন? কী আছে দক্ষিণেশ্বরে! তাঁকে জানতেই হবে। আর দেরি করলেন না নরেন্দ্রনাথ। চললেন দক্ষিণেশ্বর। গঙ্গার দিকে পশ্চিমের দরজা দিয়ে তিনি ঢুকলেন। আর ঠাকুরের মনে আবার খেলে গেল সেই অপার আনন্দের ঢেউ। ঠাকুর মনে মনে দিনটার একটা ছবি এঁকে নিলেন। আসছেন নরেন্দ্রনাথ। মাথার চুল এলোমেল। বেশভূষায় পরিপাট্য নেই। জাগতিক কোনও বিষয়েই যেন তার আঁট নেই। চোখ দুটোর দিকে তাকালেন ঠাকুর। মনে হল, কে যেন তাকে অনেকটা ভিতরের দিকে সর্বক্ষণ টেনে রেখেছে। কলকাতা জুড়ে বিষয়ী লোকের আনাগোনা। যুবকের সঙ্গেও যে ক-জন বন্ধুবান্ধব এসেছেন, সকলেই আলাদা; সবার মধ্যে স্বতন্ত্র যেন প্রদীপের শিখার মতো জ্বলছেন যুবক নরেন্দ্রনাথ। ঠাকুর মনে মনে ভাবলেন, এই কলকাতাতে সত্ত্বগুণের এতবড় আধার থাকাও কি সম্ভব!মেঝেয় ছিল মাদুর পাতা। যুবককে তিনি বসতে বললেন। গঙ্গাজলের পাত্রের কাছে গিয়ে বসলেন নরেন্দ্রনাথ। ঠাকুর আবার তাঁর কাছে গান শোনার আবদার করলেন। আর যুবক তন্ময় হয়ে গাইতে শুরু করলেন,- ‘মন চল নিজ নিকেতনে।/ সংসার-বিদেশে বিদেশীর বেশে ভ্রম কেন অকারণে।’
সেদিন গান শেষে হলে নরেন্দ্রনাথকে উত্তরের বারান্দায় টেনে নিয়ে গেলেন তিনি। চোখ দিয়ে দরদর করে ঝরছে আনন্দাশ্রু। যুবক নরেন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন, আড়ালে তাঁকে বুঝি কিছু উপদেশ দেবেন ঠাকুর। কিন্তু তা করছেন কই! তিনি যে তাঁকে দেখছেন আর শুধু অঝোরে কাঁদছেন! ঠাকুরের এমন ব্যবহারের কোনও অর্থই যে বুঝে উঠতে পারছেন না নরেন্দ্রনাথ। ঠাকুর কাঁদতে কাঁদতে তাঁর হাত ধরে বলছেন, এতদিন পরে তবে আসতে হয়? আমি যে এতদিন কী করে অপেক্ষা করে থেকেছি সে শুধু আমিই জানি; বিষয়ী লোকের কথা শুনে শুনে কান ঝলসে যাবার জোগাড়। ঠাকুর কাঁদছেন আর বলে চলেছেন, প্রাণের কথা কাকে বলব! পেট যে কথা কইতে না পেরে ফুলে গেল!
আরও শুনুন: দুঃখ-কষ্ট সত্ত্বেও এ সংসারে ঈশ্বর আমাদের রেখেছেন কেন?
ঠাকুরের দিকে তাকিয়ে তখন বিস্ময়ের ঘোর কাটছে না যুবক নরেন্দ্রনাথ! এসব কী হচ্ছে তাঁর সঙ্গে? দক্ষিণেশ্বরের এই ঠাকুর তাঁকে কী বলছেন? কেনই বা বলছেন? নরেন্দ্রনাথের যুক্তি-বুদ্ধি যেন গঙ্গার স্রোতে ভেসে যায় যায়! ঠাকুর ইতিমধ্যে তাঁর সামনে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। যেন নরেন্দ্রনাথ দেবতার মূর্তি। আর ঠাকুর তাঁর ভক্ত। সেইভাবে দাঁড়িয়ে ঠাকুর উচ্চারণ করলেন সেই অমোঘ কথাটি; বললেন, ‘জানি আমি প্রভু, তুমি সেই পুরাতন ঋষি, নররূপী নারায়ণ, জীবের দুর্গতি নিবারণ করিতে পুনরায় শরীরধারণ করিয়াছ’।
সেই শুরু হয়েছিল এক অনন্ত যাত্রা! বিস্মিত ভারতবাসী আজও সেদিকে তাকিয়ে থাকে। চিনতে পারে তার নিজ নিকেতনকে। আমাদের সকলকেই তাই একদিন না একদিন এসে দাঁড়াতে হয় রামকৃষ্ণ স্টেশনে। সেখান থেকে আমাদের সকলেরই গন্তব্য হয় বিবেকানন্দধামে।