আরাধ্যা দেবী কালীর বর্ণনা ধ্যানমন্ত্রে জেনেছেন সাধক। কিন্তু বাস্তবে সেই দিব্যমূর্তি ঠিক কেমন, সে হদিশ পাননি কারও কাছে। একদিন তিনি দৈববাণী শুনতে পেলেন, ভোরের প্রথম আলোয় তিনি নাকি খুঁজে পাবেন নিজের আরাধ্য দেবীর রূপ। শোনামাত্র ছুটলেন তিনি। কিংবদন্তি এমনই, সেদিনই তিনি খোঁজ পেলেন তাঁর সেই কাঙ্ক্ষিত দেবীরূপের। আর তারপর থেকেই বাংলায় আবির্ভাব ঘটল দক্ষিণা-কালীর মূর্তি। কে সেই সাধক? ভোরের প্রথম আলোয় তিনি দেখেছিলেনই বা কী? আসুন, শুনে নিই।
একসময় মা কালীর কোনও মূর্তি থাকত না সাধকের সামনে। কেবলমাত্র শ্মশান কিংবা গভীর অরণ্যের নির্জনতাকেই কালীপূজার উপযুক্ত স্থান হিসেবে ধরা হত। তখনকার বাংলায় প্রচলন ছিল না কোনও কালী বিগ্রহেরও। তাই কখনও প্রদীপ জ্বালিয়ে আবার কখনও শিলাখণ্ড সামনে রেখেই চলত মাতৃ আরাধনা। কিন্তু মায়ের মূর্তি স্বচক্ষে দেখার জন্য আকুল হতেন কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ নামে এক মাতৃসাধক। তাঁর সেই আকুলতায় সাড়া না দিয়ে থাকতে পারেননি স্বয়ং দেবীও। গ্রাম্যবধূর রূপেই তিনি ধরা দিয়েছিলেন সাধক কৃষ্ণানন্দের সামনে। আর তারপর ধীরে ধীরে কৃষ্ণানন্দের হাত ধরে শ্মশানবাসিনী কালী হয়ে উঠলেন বাংলার আদরিণী শ্যামা।
আরও শুনুন: কেরানি থেকে হলেন সাধক কবি, মা কালী কি সত্যিই কৃপা করেছিলেন রামপ্রসাদ সেনকে?
বলা হয়, কার্তিকমাসের অমাবস্যায় অনুষ্ঠিত দীপান্বিতা কালীপুজোর সূচনা করেছিলেন কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। শ্রীচৈতন্যের জন্মস্থান নবদ্বীপই ছিল কৃষ্ণানন্দের তন্ত্রচর্চার পীঠস্থান। সেখানে নিষ্ঠাভরে মায়ের নাম জপ করলেও তন্ত্রমতে দেবীর মূর্তি কেমন হবে, সে বিষয়ে কোনও ধারণা ছিল না তাঁর। দেবীর চার হাতের মধ্যে কোন হাতে খড়্গ, কোন হাত অভয়মুদ্রার, দেবীর কোন পা মহাকাল মহাদেবের বুকে রাখা হবে, এসবের কিছুই ঠিক করে কল্পনা করতে পারতেন না তিনি। তাই সবসময় এক অস্থিরতা কাজ করত তাঁর মধ্যে।
এমন সময় কোনও এক ভোররাতের স্বপ্নে আচমকা ঘুম ভাঙে তন্ত্রসাধক আগমবাগীশের। তাঁর মনে হয় কেউ তাঁকে বলছে, এই ভোরের প্রথম আলোতেই তিনি নাকি খুঁজে পাবেন নিজের আরাধ্য দেবীর রূপ। এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে অজানার উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করেন সাধক। কিছুদুর হেঁটেই তিনি পৌঁছান এক গ্রামে। সেই ভোরের আলোয় তিনি দেখেন, সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন জনৈক শ্যামবর্ণা গ্রাম্যবধূ। পরনে খাটো কাপড়, নিজের ডান পা সামনের দিকে এগিয়ে দেওয়ালে মাটি দিচ্ছেন সেই মহিলা। তাঁর ঘন কালো চুল কোমর ছাড়িয়ে ঢেকে রেখেছে তাঁর পিঠ। হঠাৎ করে পরপুরুষকে সামনে দেখতে পেয়ে অপ্রস্তুতে পড়েছেন তিনিও। অজান্তে কোনও ভুল করলে আমরা যেভাবে জিভ বের করে ফেলি, সেই মহিলাও তেমনটাই করে ফেলেছেন। তাঁর কপালে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘামে লেপ্টে গিয়েছে তাঁর সিঁদুরের টিপ। এমন দৃশ্য দেখেই কৃষ্ণানন্দের মনে পড়ে গেল তন্ত্রে বর্ণিত দেবী কালীর ধ্যানমন্ত্র, ‘করালবদনাং ঘোরাং মুক্তকেশীং চতুর্ভুজাম, কালিকাং দক্ষিণাং দিব্যাং মুণ্ডমালাবিভূষিতাং…’ এই মহিলাও তো ঠিক সেইভাবেই দাঁড়িয়ে। ডান পা সামনে, দুই হাত বিশেষ ভঙ্গিতে রাখা। সাধক বুঝতে পারলেন ভোরের সেই দৈববাণী মিলে গেছে। এই মহিলাই তাঁর আরাধ্যার প্রতিরূপ। করজোড়ে সেই দেবীকে প্রণাম করে সেদিন বাড়ি ফিরেছিলেন কৃষ্ণানন্দ।
আরও শুনুন: পিয়ানো বাজান, ঘোড়াও চড়েন… কলকাতার পুরনো বাড়িতে এখনও নাকি দেখা মেলে ‘তেনাদের’
তারপর একাগ্র মনে সেই দৃশ্যকে কল্পনা করেই তন্ত্রাচার্য কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ গড়েছিলেন দেবী দক্ষিণাকালীর মুর্তি। আজ থেকে আনুমানিক ৫০০ বছর আগে নবদ্বীপের জঙ্গলাবৃত দ্বীপে এভাবেই তৈরি হয়েছিল আজকের ঘরে ঘরে পূজিত ও প্রচলিত শ্যামা তথা কালীমূর্তি। নবদ্বীপের আগমেশ্বরীপাড়ায় কৃষ্ণানন্দের প্রবর্তিত এবং প্রচলিত সেই পদ্ধতি অনুসারে এখনও পঞ্চমুণ্ডির আসনে কালীপুজো হয়ে আসছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মায়ের রূপের আরও অনেক প্রকারভেদ এসেছে। কিন্তু ধ্যানমন্ত্র অনুসারে দেখলে, দেবীরূপের যথার্থ নির্মাণ করেছিলেন মাতৃসাধক আগমবাগীশ-ই।