পুরাণ মতে তিনি সর্পকুলের জননী। অষ্টনাগ তাঁকে সবসময় বেষ্টন করে থাকে। স্বয়ং দেবাদিদেব মহেশ্বর তাঁর পিতা। তবে শিবের ঔরসজাত হলেও, দেবীত্ব লাভের পথে বহু সংগ্রাম করতে হয়েছিল তাঁকে। কথা বলছি, দেবী মনসাকে নিয়ে। তাঁকে ঘিরে প্রচলিত গল্পগুলির বেশিরভাগই আঞ্চলিক বা লোকায়ত। তবু তাঁকে কেবলমাত্র লৌকিক দেবী হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না। শুধুমাত্র গ্রাম নয় শহরাঞ্চলেও তাঁর মন্দির লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতে তাঁর পুজো নিয়ে দেখা যায় উন্মাদনা, আগ্রহ। শ্রাবণ মাসের শুক্ল পক্ষের পঞ্চমী তিথি, নাগপঞ্চমী হিসেবে আখ্যায়িত। এই দিনই দেশ জুড়ে সাড়ম্বরে পালন করা নাগ পুজো। শুধুমাত্র দেবী মনসা নয়, এইদিন পুজো করা হয় বিভিন্ন নাগ-নাগিনীদেরও। কী এই পুজোর মাহাত্ম্য? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। শ্রাবণ মাসে পালন করা পার্বণগুলির মধ্যে অন্যতম হল ‘নাগপঞ্চমী’। তবে এই পার্বণ শুধু বাঙালিদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। গ্রামবাংলার একটি অতি প্রচলিত ও জনপ্রিয় উৎসব হলেও নাগপঞ্চমী পালিত হয় গোটা দেশজুড়ে। এমনকী কেরল-সহ ভারতের বেশ কিছু জায়গায় রয়েছে নাগ দেবতার মন্দিরও। বাংলায় মনসামঙ্গল কাব্য মনসার দেবীত্ব লাভের সেই কাহিনি আমাদের শোনায়। সেখানে উল্লেখ রয়েছে চাঁদ সদাগরের কথা। তাঁর হাতে পুজো পেয়েই নাকি বাংলায় মনসার পুজো শুরু হয়েছিল। তবে পুরাণ বলে অন্য এক গল্প। সেই গল্পের সূত্র ধরেই নাগপঞ্চমীর সূত্রপাত।
আরও শুনুন: ‘আমাকে কি ত্যাগ করবেন?’ প্রশ্ন ধর্মত্যাগী মাইকেল মধুসূদনের, ঠাকুর বললেন…
হিন্দু পুরাণানুসারে, শ্রীকৃষ্ণের এক লীলাকথন বর্ণিত আছে নাগপঞ্চমীর ইতিহাস হিসাবে। তাঁর বাল্যকাল কেটেছে যমুনা নদীর তীরবর্তী বৃন্দাবনে। তাই প্রায়ই সখাদের নিয়ে জলক্রীড়ায় মত্ত হতেন বালক কৃষ্ণ। এমনই একদিন খেলতে খেলতে তিনি কালীয় নামে এক বিশাল নাগের মুখোমুখি হন। ভয়ানক বিষধর সেই বিশাল কালীয় নাগের বিষে গোটা যমুনার জল হয়ে যায় নীল। গোটা গ্রামের মানুষ সেই দেখে রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। তবে বালক কৃষ্ণের কাছে সেই নাগকে পরাস্ত করা মোটেও কঠিন কাজ ছিল না। প্রবল যুদ্ধের শেষে হার স্বীকার করতে বাধ্য হন কালীয় নাগ। বালকের মধ্যেই স্বয়ং ভগবানকে দেখতে পেয়ে কালীয় নিজের প্রাণ ভিক্ষা চান কৃষ্ণের কাছে। সেই ঘটনা পুরাণে ‘কালীয়দমন’ নামে পরিচিত। এই বাল্যলীলায় বৃন্দাবনবাসীকে আতঙ্কের হাত থেকে মুক্তি দেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। কালীয় নাগও সেই স্থান ত্যাগ করে, কোনরূপ ক্ষতি না করার আশ্বাস দিয়ে। বলা হয়, এই ঘটনার স্মরণেই পালন করা হয় নাগপঞ্চমী। অনেকের মতে আবার এই ব্রতের সঙ্গে যোগ রয়েছে দেবাদিদেব মহেশ্বরের। শিবের প্রিয় মাস হল এই শ্রাবণ। আবার শিবের কণ্ঠভূষণ হয়ে থাকে নাগ। তাই শ্রাবণ মাসেই পালন করা হয় নাগপঞ্চমী।
আরও শুনুন: যত মত তত পথ – সমন্বয়ের এই বাণীই মানবের চালিকাশক্তি
নাগপঞ্চমীর দিনে বিশেষ এক প্রথার প্রচলন রয়েছে মহারাষ্ট্রে। সেখানে সর্পদেবতাকে পূজা নিবেদন করেন ভক্তরা। তবে এই পূজার বিশেষত্ব হল, মূর্তি নয়, জীবন্ত সাপকেই পূজা করা হয়। অন্যদিকে কেরলের নাগ দেবতার মন্দিরে দলে দলে ভক্তরা আসেন পুজো দিতে। প্রত্যেকেরই প্রার্থনা পরিবারের কারোর যেন সর্প দংশনে মৃত্যু না হয়। আমাদের রাজ্যে, অর্থাৎ বাংলাতে এই মনসাপুজোর সঙ্গে বৃক্ষপুজোর রীতি মিলেমিশে গিয়েছে। একটি বিশেষ গাছকেই এখানে দেবী মনসা হিসাবে পূজা করা হয়। আবার কোথাও মূর্তি পুজোর চলও রয়েছে। অনেকে আবার মনে করেন নাগ পঞ্চমীর দিন নাগ পুজো করলে সন্তুষ্ট থাকেন স্বয়ং শিবও। তাই সব মিলিয়ে পরিবারের মঙ্গল কামনার কথা ভেবে নাগপঞ্চমীর পুজো সাড়ম্বরে পালন করেন দেশবাসী।