সত্য এবং অহিংসা জীবের শ্রেষ্ঠ ধর্ম। যদি কেউ তা অবলম্বন করতে পারেন, তবে তিনি সর্বভূতের মঙ্গলসাধন করতে পারেন। এদিকে শাস্ত্রই আবার বলে, কখনও সখনও সত্যর থেকে মিথ্যার গুরুত্ব বেশি হয়। কখন আসে এমন মুহূর্ত, যখন সত্যের থেকে মিথ্যে হয়ে ওঠে শ্রেয়? শোনাচ্ছেন, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়।
জীবের শ্রেষ্ঠ ধর্ম কী? মানুষের জীবন যত এগিয়েছে, যুগে যুগে বহু মানুষের মনে ফিরে ফিরে এসেছে এই প্রশ্নখানা। মানুষ জানতে চেয়েছে, ধর্মের সেই মোক্ষম পথটিকে, যা অবলম্বন করে সকলের মঙ্গলসাধন সম্ভব। থেকে থেকেই তাই এই প্রশ্ন নিয়ে মানুষ ফিরে ফিরে গিয়েছে মনীষীগণের কাছে, যুগপুরুষের কাছে। আর, আমাদের শাস্ত্রকাররা এর উত্তরও দিয়েছেন বিভিন্ন ভাবে। কখনও গল্পচ্ছলে বলে দেওয়া হয়েছে পথের সন্ধান। কখনও আবার সরাসরি। মহাভারত মহাগ্রন্থ থেকে যেমন আমরা পেয়ে যাই এর এক চমৎকার উত্তর। যা সর্বভূতের হিতকর, তাই-ই শ্রেষ্ঠ ধর্ম। আর, সেই দুই ধর্ম হল সত্য এবং অহিংসা। – অহিংসা সত্যবচনং সর্বভূতহিতং পরম্ । – অর্থাৎ সত্য আর অহিংসাকেই দেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ স্থান।
আরও শুনুন: Spiritual : যত মত তত পথ – সমন্বয়ের এই বাণীই মানবের চালিকাশক্তি
বলা হয়ে থাকে, সত্যের থেকে শ্রেষ্ঠ ধর্ম আর নেই। কত না ভাবে আমাদের শাস্ত্রে পুরাণে এই কথাটি বলে দেওয়া হয়েছে, গুণকীর্তন করা হয়েছে সত্যের। ব্যাখ্যা করা হয়েছে সত্যের মহিমা। সত্যবাদীর জয়গান গাওয়া হয়েছে কত না উপায়ে। তবু এ কথা তো মানতেই হবে, জীবনের থেকে আশ্চর্য ঘটনা আর কিছুই নেই। কখন যে কোন বাঁকের সামনে জীবন আমাদের এনে দাঁড় করায় তার হদিশ মেলে না। আমাদের শাস্ত্রকাররা জীবনের এই বাঁকবদলের কথা জেনে তাই এর প্রতিবিধান করেই গিয়েছেন। শাস্ত্র তাই বলছে, এমন মুহূর্ত আসে যখন সত্যের থেকে হয়তো মিথ্যের গুরুত্বই বেশি হয়ে দাঁড়ায়, তখন মিথ্যে বললে পাপ হয় না। যেটুকু দোষ হয় তা কাটাতে বাগ্দেবীর অর্চনা করে নেওয়াই উপায়।
এইখানে এসে মন উৎসুক হয়ে ওঠে, জানতে ইচ্ছে করে, কখন আসে সেই মুহূর্ত যখন মিথ্যেকেও সত্যের উপরে স্থান দিয়েছেন আমাদের শাস্ত্রকাররা। পিতামহ ভীষ্ম ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে এই প্রসঙ্গেই একবার ধরিয়ে দিচ্ছেন সঠিক পথের দিকনির্দেশ। বলছেন, যখন সত্য মিথ্যারূপে আর মিথ্যা সত্যরূপে প্রতিভাত হচ্ছে আমাদের সামনে, তখন সত্যর জায়গায় মিথ্যেই প্রকৃত সত্য হয়ে ওঠে। কেন-না, তাতেই সর্বভূতের হিত সম্ভব।
এই উপদেশই সারমর্মটুকু পাওয়া যায় গল্পের আধারেও। গল্পটি বলছে, একবার একদল দস্যু প্রাণহরণ করবে বলে বা ধনসম্পত্তি ছিনিয়ে নেবে বলে এক ব্যক্তির পিছনে ধাবমান; পথের পাশে বসে থাকা এক ঋষি দেখলেন সেই ঘটনাটি। অর্থাৎ, তিনি দেখলেন লোকটি প্রাণভয়ে পলায়ন করছেন। কিছুক্ষণ পরেই তাঁর সামনে এসে হাজির হল দস্যুরা। জিজ্ঞেস করল, লোকটি কোনদিকে গিয়েছে? এখন প্রশ্ন, এই মুহূর্তে সত্য কথা বলা কি ঋষির পক্ষে শ্রেয়? তাতে তো একজনের প্রাণহানির সম্ভাবনা আছে। আবার যদি সত্যি না বলেন ঋষি তবে তিনি অধর্মে পতিত হন। এই হল নৈতিক সংকট। পাশ্চাত্যের নীতিশাস্ত্র এর উত্তরে মৌনই থেকেই গিয়েছে, কিন্তু আমাদের শাস্ত্রকাররা এর যথাযথ মীমাংসা করেছেন। স্পষ্টতই জানিয়ে দিয়েছেন, সত্যের বদলে মিথ্যে বলাই এখানে শ্রেয়। প্রথম কর্তব্য এই পরিস্থিতিতে মৌন থাকা। একান্তই যদি তা না সম্ভব হয়, তাহলে যাতে ধনপ্রাণ রক্ষা হয়, সেই পথই অনুসরণ করা উচিত। কেন-না মানুষের ক্লেশ নিবারণের জন্যই তো ধর্মের সৃষ্টি। তাই ধর্মের পথ অবলম্বন করলে সেদিকটাকেই সবার আগে গুরুত্ব দিতে হবে।
নারদ তাই বলছেন,
সত্যস্য বচনং শ্রেয়ঃ সত্যাদপি হিতং বদেৎ।
যদ্ভুতহিতমত্যন্তং এতৎ সত্যং মতং মম।।
আরও শুনুন: Spiritual: শাস্ত্রমতে কে আসলে প্রকৃত ধার্মিক? কী তাঁর নিত্যকর্তব্য?
সত্য কথা বলা নিশ্চয়ই শ্রেয়। কিন্তু তার আগেও আমাদের খেয়াল রাখতে হবে আমাদের বলা সত্য সর্বভূতহিতকর হচ্ছে কি-না। কেন-না যা সর্বভূতের হিত করে তাই-ই প্রকৃত সত্য। আর সত্যের থেকে শ্রেষ্ঠ ধর্ম আর কিছু নেই।
এইভাবে আমাদের শাস্ত্র আমাদের মনের জানলাগুলো খুলে দেয়। নীতি-যুক্তির অরণ্যে কেবল এলোমেলো ভ্রমণের কথা বলে না, বলে না পদে পদে নিয়মের ডোরে বেঁধে থাকার কথা, বরং বলে খোলামনে এই পৃথিবীকে, এই পৃথিবীর মানুষকে সঙ্গে নিয়ে সকলের মঙ্গলচিন্তা করিয়ে মানবসভ্যতার অগ্রগতির কথা। ধর্মতত্ত্বের পরতে পরতে মিশে আছে এমনই সব আশ্চর্য আখ্যান।