যুগপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণের উদার অমৃতকথা আমাদের পৌঁছে দেয় জীবনের সার্থকতায়। ঈশ্বরে মন রেখেই সাংসারিক কর্তব্যপালনের যে অমোঘ পথ তিনি দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন, তাই-ই আজও আমাদের পাথেয়। সেই কথাই উঠে এসেছে সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের ‘পরমপদকমলে’ গ্রন্থে। আসুন শুনে নিই সেই অমৃতপ্রসঙ্গ।
বিশেষ কৃতজ্ঞতা: উদ্বোধন কার্যালয়
অর্থ জরুরি। তবে, তার থেকেও জরুরি ঈশ্বরের কৃপা লাভ। অর্থের মোহ না গেলে তা সম্ভব হয় না। ঠাকুর বলতেন, কেউ যদি নিজেকে ধনী ভাবে, তবে, তার থেকেও বড় ধনী আছে। টাকায় অহঙ্কার আসে। সে মোহ যায় কী করে? সার আর অসার ভেদ করতে জানলেই আর মোহের ফাঁস চেপে ধরে না। ঠাকুরের এই দর্শন খুব প্রাঞ্জল ভাবে সকলের সামনে তুলে ধরেছেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়। তাঁর বিখ্যাত বই ‘পরমপদকমলে’-তে ‘অনুগ্রহ’ শীর্ষক অধ্যায়ে তিনি লিখেছেন,
‘ ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলছেন: “দুরকম মাছি আছে-একরকম মধুমাছি, তারা মধু ভিন্ন আর কিছুই খায় না। আরেক রকম মাছি মধুতেও বসে, আর যদি পচা ঘা পায় তখনি মধু ফেলে পচা ঘায়ে গিয়ে বসে।” মানুষ তাঁর কৃপা বলতে বোঝে নিজের বৈষয়িক উন্নতি! বাড়ি নেই, একটা বাড়ি চাই। ব্যবসায়ী হলে ব্যবসায়ে উন্নতি। চাকরি হলে তরতর প্রমোশন। নেতা হলে গদির স্বপ্ন। চাই ভার্যাং মনোরমাং। ছেলের প্রতিষ্ঠা, মেয়ের বিয়ে খুব ভাল ঘরে। বিলেত-ফেরত জামাই। নীরোগ শরীর। চিতায় ওঠার আগে পর্যন্ত ভোগের যন্ত্রপাতি যেন ঠিক থাকে। চোখ, কান, দাঁত, নাক। মাঝে মধ্যে অসুখ করুক ক্ষতি নেই, তাঁর কৃপায় যেন তিনদিনে চাঙ্গা হই। তিনি যেন বসে আছেন কোথাও, আমার ইচ্ছাপূরণের ঝুলি নিয়ে। যা চাইব তাই যেন পাই। পেলেই তিনি আছেন, না পেলে নেই। এমনকি লটারির টিকিট কেটে তিনবার কপালে ঠেকাই ‘মা, দশলাখ, মা, বিশলাখ।’ মা হাসেন-গাধা, আসল নকল চিনলি না। কোনটা সার, কোনটা অসার, কোনটা মায়া? ‘ … ঠাকুর বলতেন, টাকায় কি হয়। চাল, ডাল, আটা, ময়দা, কাপড়, জামা, গাড়ি, বাড়ি। তারপর ভোগ বাড়ালেই ভোগ বাড়ে। টাকায় আসে অহঙ্কার। টাকার অহঙ্কার করতে নেই। যদি বল আমি ধনী, ধনীর আবার তারে বাড়া, তারে বাড়া আছে। সন্ধ্যার পর যখন জোনাকি পোকা ওঠে সে মনে করে আমি এই জগৎকে আলো দিচ্ছি; কিন্তু যেই নক্ষত্র উঠল, অমনি তার অভিমান চলে গেল। তখন নক্ষত্রেরা মনে করে আমরা জগৎকে আলো দিচ্ছি, কিন্তু পরে যখন চন্দ্র উঠল তখন নক্ষত্রেরা লজ্জায় মলিন হয়ে গেল। চন্দ্র মনে করলে আমার আলোয় জগৎ হাসছে। দেখতে দেখতে অরুণোদয় হলো তখন চন্দ্র মলিন হয়ে গেল। খানিক পরে আর দেখা গেল না। ধনীরা যদি এগুলি ভাবে, তাহলে আর তাদের ধনের অহঙ্কার থাকে না।’
এই বোধটুকু থাকলে কামিনী-কাঞ্চনে আর আসক্তি থাকে না।