তিনি বৃহৎ, ব্যাপক। আবার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবের অন্তরেও তাঁরই বাস। জগতের সব পরিবর্তনই যেন তাঁর লীলা। শ্রীধাম পুরীর অধিশ্বর প্রভু জগন্নাথ। সাধারণ দেববিগ্রহের একেবারেই ব্যতিক্রম হিসবে তাঁর প্রকাশ। তবে শুধু বিগ্রহ নয়। অপার রহস্যে ভরা পুরীর মন্দিরও। যা আজও ভেদ করে উঠতে পারেননি কেউই। আসুন শুনে নিই, পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের আড়ালে লুকিয়ে থাকা সেইসব রহস্যের কথা।
ভারতবর্ষের সনাতন ধর্মের ভিতর যে অপূর্ব সমন্বয়ের সংস্কৃতি নিহিত আছে, প্রভু জগন্নাথদেব তাঁরই মূর্ত প্রতীক। বছরে একবার রথে চড়ে নগর পরিক্রমায় বেরোন প্রভু। সঙ্গে থাকেন দাদা বলরাম ও বোন সুভদ্রা। আর তাঁদের সেই যাত্রায় শামিল হন দেশ বিদেশের লাখো লাখো ভক্ত। শোনা যায়, প্রভু জগন্নাথের রথযাত্রা ঘিরে এই বিশাল আয়োজন বিস্মিত করেছিল ব্রিটিশদেরও। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল প্রভুর অদ্ভুত লীলাকাহিনি। আর ছড়িয়েছিল কিছু রহস্যের কথা। যা আজও ভেদ করতে পারেননি দেশ-বিদেশের কেউই।
আরও শুনুন: সোমবার শিবের উপাসনা করলে পূর্ণ হয় মনস্কামনা, জানায় দৈবী কাহিনি
রহস্যের প্রসঙ্গে প্রথমেই আসে পুরীর মন্দিরের চূড়ায় থাকা ধ্বজাটির কথা। সাধারণত যেদিকে হাওয়া দেয়, পাতলা কাপড় বা কাগজের সেদিকেই ওড়া উচিত। কিন্তু জগন্নাথ মন্দিরের পতাকাটির ক্ষেত্রে এই নিয়ম কার্যকর হয় না। কিন্তু অলৌকিক ভাবেই, এই পাতলা বস্ত্রখণ্ডটি হাওয়ার বিপরীতে ওড়ে। অনেকেই এই ঘটনা চাক্ষুষ না দেখা অবধি বিশ্বাস করতে চান না। কিন্তু যাঁরা একবার এই বিস্ময়দৃশ্য দেখেছেন তাঁরা মনে মনে হলেও, প্রভুর অলৌকিক অস্তিত্বের কথা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন।
এরপরেই আসে ছায়ার প্রসঙ্গ। বিজ্ঞান বলে, আলোর পথে বাধা তৈরি হলেই সেই বাধা দেওয়া বস্তুর পিছনে কালো ছায়া তৈরি হয়। দিনের আলোয় বড় গাছ, বড় বাড়ি কিংবা মন্দিরের ছায়া পড়া খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম পুরীর জগন্নাথ মন্দির। সূর্য যে অবস্থাতেই থাকুক কোনোদিন জগন্নাথ মন্দিরের এতটুকু ছায়া মাটিতে পড়ে না। এ তো গেল মন্দিরের কথা। এবার আসা যাক জগন্নাথের ভোগ প্রসঙ্গে। প্রতিদিন ৫৬ রকমের ভোগ নিবেদন করা হয় প্রভু জগন্নাথকে। যা রান্না করা হয় এক বিশেষ পদ্ধতিতে। একটি বড় উনুনে একটার উপর একটা মাটির হাঁড়ি সাজিয়ে ভোগ রান্না হয়। এক্ষেত্রেও বিজ্ঞানের সাধারণ নিয়ম বলে, যে হাঁড়িটি আগুনের সবথেকে কাছে আছে, তাতেই সবার আগে রান্না শেষ হবে। কিন্তু জগন্নাথের ভোগরান্নার ক্ষেত্রে হয় ঠিক উল্টোটা। অর্থাৎ যে হাঁড়িটি সবচেয়ে উপরে আছে বা আগুন থেকে সবথেকে অধিক দূরত্ব যার, সেই হাঁড়ির ভোগই আগে সিদ্ধ হয়। আবার প্রতিদিন যতই ভক্ত আসুক না কেন মন্দিরের ভোগ কখনও কম বা বেশি হয় না। দু’হাজার ভক্ত এলেও ভোগ অতিরিক্ত পড়ে থাকে না, আবার বিশ হাজার ভক্ত এলেও ভোগ না নিয়ে কাউকে চলে যেতে হয় না।
আরও শুনুন: দেবতাদের অস্ত্র, যাদের থামাতে পারে না কোনও শক্তিই
তবে সবথেকে আশ্চর্যের বিষয়, এই মন্দিরের শব্দ-রহস্য। মন্দিরের একাবারেই কাছে রয়েছে সমুদ্র। মন্দির সংলগ্ন যে কোনও জায়গাতেই সেই সমুদ্রের গর্জন স্পষ্ট শোনা যায়। কিন্তু একবার মন্দিরের সিংহ দরজার ভিতরে পা রাখলেই চারিদিক শান্ত, নিশ্চুপ। অত্যাধুনিক কারিগরি নাকি দৈবের লীলা, কীভাবে এমনটা সম্ভব হয় তার উত্তর মেলেনি আজও। এমনই বিভিন্ন রহস্যে মোড়া পুরির জগন্নাথ মন্দির। তবে সব শেষে যা না বললেই নয়, তা হল মন্দিরের উড়ানবিধি রহস্য। এমনিতে কোনও বড় মন্দির বা বাড়ির উপর দিয়ে হামেশাই বিভিন্ন বিমান উড়ে যেতে দেখা যায়। তা না হলেও পাখি ওড়ে না এমন কোনও জায়গা নেই বললেই চলে। ব্যতিক্রম এই পুরীর মন্দির। শোনা যায়, এখনও পর্যন্ত একটি পাখি কিংবা বিমান এই মন্দিরের উপর দিয়ে উড়তে দেখা যায়নি। অথচ সরকারের তরফে যে বিশেষ কোনও নিষেধ রয়েছে এমনটাও নয়। তবু কোনও বিমান ওড়ে না এই মন্দিরের উপর দিয়ে। আর পাখিরা যে কেন এমনটা করে সে প্রশ্নের উত্তর কারও কাছেই নেই। অনেকেই নেপথ্যে যুক্তি খোঁজার চেষ্টা করেন তবে ভক্তের কাছে এ সবই দৈব-লীলা। পুরুষোত্তম জগন্নাথের অধিষ্ঠান যেখানে, সেখানের নিয়মকানুন যে সাধারণের থেকে আলাদা হবে এমনটাই ভেবে নেন তাঁরা।