দুর্গাপুজো মানে কেবল চার দিন নয়। বছর জুড়ে নানা তিথিতেই চলে দেবী আরাধনার প্রস্তুতি। দেবীপক্ষে সেই প্রস্তুতির কথা জানালেন সৌভিক রায়।
রবি ঠাকুর লিখে গিয়েছেন, ‘আশ্বিনের মাঝামাঝি উঠিল বাজনা বাজি, পূজার সময় এল কাছে।’ আশ্বিন এলেই মন বলে ওঠে, মা আসছে। ভোরে শিউলির সুবাস, সন্ধ্যায় ছাতিমের গন্ধ। শহরের দিকে দিকে ম্যারাপ বাঁধা। এ দৃশ্য বাঙালির মনে হিল্লোল তোলে। চারটি দিনের অপেক্ষায় কাটে গোটা বছর। কিন্তু পুজো মানেই কি কেবল চারটি দিন?
না, কখনোই নয়। আজ নাহয় খুঁটি পুজো, থিম প্রকাশ ইত্যাদি নানাবিধ অনুষ্ঠানের জেরে পুজোর প্রস্তুতি শুরু হয় মে-জুন মাস থেকে। কিন্তু আবহমান কাল থেকেই বাঙালির নানান পার্বণে জড়িয়ে আছেন দেবী দুর্গা। রথযাত্রা, জন্মাষ্টমীর মতো নানান তিথি ঘিরে শুরু হয় পুজোর প্রস্তুতি। সেও তো পুজোর অঙ্গ।
কোথাও কোথাও অক্ষয় তৃতীয়ার দিন শুরু হয় দেবী দুর্গার মূর্তি গড়ার কাজ। বৈশাখের শুক্লপক্ষের তৃতীয়ায় গঙ্গা থেকে মাটি তোলেন কুমোর, পটুয়ারা। সেই মাটিই মিশিয়ে নেন মূর্তি গড়ার মাটির সঙ্গে। তারপর আসে রথযাত্রা। আষাঢ়ে সোজা রথ, উল্টোরথ দুই তিথিতেই চলে কাঠামো পুজো। বহু বনেদি বাড়ি, যাঁদের বাড়িতে এখন আর ঠাকুর গড়া হয় না, তাঁরা রথের দিন কুমোরের কাছে ঠাকুর বায়না দিতে যান। দুশো বছরের বেশি পুরোনো জলপাইগুড়ির নিয়োগীবাড়ির ঠাকুর বায়না হয় রথের দিন। শোভাবাজার রাজবাড়িতে (বড় তরফ), ধান্যকুড়িয়ার গাইন বাড়িতে রথযাত্রার দিন কাঠামো পুজো হয়। বহু প্রাচীন পুজোয় এই দিন খড় বাঁধা কাঠামোয় প্রথম মাটির প্রলেপ পড়ে।
ভাদ্রের সবচেয়ে বড় উৎসব জন্মাষ্টমী। ওই দিন বেলুড় মঠে দেবীর কাঠামো পুজো হয়। হাওড়ার খসমরা গ্রামের ঘোষবাড়ির দুর্গার কাঠামোও কৃষ্ণের জন্মতিথিতে পুজো পায়। তারপর শুরু হয় খড় বাঁধা। জন্মাষ্টমীর পরদিন হয় নন্দোৎসব। ওইদিন জলপাইগুড়ির বৈকুণ্ঠপুর রাজবাড়িতে মূর্তি গড়া আরম্ভ হয় কাদা-মাটি খেলার মধ্য দিয়ে। দধিকাদো খেলার আয়োজন করেন রাজবাড়ির সদস্যরা। কাঠামো পুজোর পর নাটমন্দিরের পাশে ‘কাদা খেলার পুকুর’-এ কাদামাটির সঙ্গে দই মিশিয়ে দেন পুরোহিত। এরপর তরুণরা দধিকাদো খেলা শুরু করেন। কাদা খেলার মাটি রেখে দেওয়া হয় নাটমন্দিরে। প্রতিমা গড়ার সময় ওই কাদামাটি প্রতিমা গড়ার এঁটেল মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়। ভাদ্রের অমাবস্যায়, অর্থাৎ কৌশিকী অমাবস্যায় বৃষ্টির জল ধরে রাখা হয় বরাহনগরের নিয়োগী বাড়িতে। এদিকে সাত সমুদ্র, তেরো নদীর জল আসে। নিয়ে আসা হয় সাত পর্বতের মাটি। কৌশিকী অমাবস্যায় ধরে রাখা বৃষ্টির জল মিশিয়ে মহাস্নানের বারি প্রস্তুত করা হয়। নিয়োগী বাড়ির দুর্গা সাত সমুদ্র, তেরো নদীর জল ও সাত পাহাড়ের মাটিতে মহাস্নান সারেন রাজকীয়ভাবে।
তবে আরও দুটি তিথির কথা না বললেই নয়। দুগ্গাপুজোর ষষ্ঠীর ঠিক এক মাস আগে ভাদ্র মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠীতে বাংলার ঘরে ঘরে পালিত হয় চাপড়াষষ্ঠী ব্রত। পল্লিবাংলার এক প্রচলিত কথা,
“চাপড়া এল ধেয়ে,
সকল পরব নিয়ে”
পুজো-পার্বণ, উৎসবের মরশুম এই চাপড়াষষ্ঠী থেকেই শুরু হয়ে যায়।
দ্বিতীয় তিথিটি হল জিতাষ্টমী। জন্মাষ্টমীর এক মাস পর ও দুর্গাপুজোর অষ্টমীর এক পক্ষকাল আগের এই তিথিতে জীমূতবাহনের পুজো হয়। বলা হয়, ‘জিতার ডালায় বোধন আসে।’ কারণ, জিতাষ্টমীর পর দিন কৃষ্ণানবম্যাদি কল্পারম্ভ বোধন হয়। অর্থাৎ দুর্গাপূজার সাতটি কল্পের মধ্যে প্রথম কল্পের বোধন। তিথি অনুযায়ী, কৃষ্ণপক্ষের নবমী থেকে মল্লরাজাদের দুর্গাপুজো আরম্ভ হয়, এই তিথিতেই বেদিতে ওঠেন শোভাবাজার রাজবাড়ির দেবী দুর্গা।
এভাবেই চারদিনের উমা আরাধনার আগে বছরভর প্রস্তুতি চলে বাঙালির। এক-একটা করে তিথি আসে, আর অপেক্ষার পারদ চড়তে থাকে। তারপর আবাহন, পুজো সেরে একসময় আসে নিরঞ্জনের পালাও। ফের শুরু হয় এক বছরের প্রতীক্ষা।