মাসির বাড়ি একা গিয়েছেন প্রভু জগন্নাথ। নিয়ে যাননি স্ত্রীকে অর্থাৎ দেবী লক্ষ্মীকে। এইবার যখন ঘরে ফেরার পালা, অর্থাৎ পুনর্যাত্রা অন্তে যখন রত্নবেদীতে পুনরায় অধিষ্ঠিত হবেন রাজাধিরাজ জগন্নাথ, তখন এক অপূর্ব লীলার সূচনা। লিখলেন অরিঞ্জয় বোস।
ভক্তমনের কল্পনা ছাড়া ভগবানের লীলা যেন অসম্পূর্ণ। তত্ত্বের ভার পেরিয়ে, শাস্ত্রকে স্বীকৃতি দিয়েই, ভক্ত আপনমনের মাধুরী মিশিয়ে আরাধ্যের লীলারস আস্বাদন করেন। আমরা তাই দেখি বাৎসল্য, সখ্য, মধুররসের অপূর্ব সব বর্ণনা। যেখানে, ভক্তকল্পনায় অখণ্ডসত্তা ঈশ্বরও মগ্ন মানবলীলায়। কখনও তিনি সখার সঙ্গে ক্রীড়ামত্ত, কখনও আবার ভক্তের বিরহভারে তিনি কাতর। আবার মান-অভিমানের পালাতেও তিনি অংশ নিচ্ছেন। শ্রীক্ষেত্রে লীলাপুরুষোত্তম প্রভু জগন্নাথকেও তাই এমনই লীলার অনুষঙ্গে আরাধনা করেন তাঁর ভক্তরা।
আরও শুনুন: নীল বর্ণের জগন্নাথ, মহিলারাও অংশ নেন প্রভুর এই বিশেষ রূপের পুজোয়
শ্রীরাধার মানভঞ্জনের নিমিত্ত একদা বৃন্দাবনধামে মিনতি করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। পদাবলি সাক্ষ্য দেয় সেই অপরূপ লীলামাধুরীর। অনুরূপ এক মানভঞ্জন পালা অনুষ্ঠিত হয় পুরীধামেও। এই লীলার কেন্দ্রে প্রভু জগন্নাথ আর দেবী লক্ষ্মী। রথযাত্রা উপলক্ষে জগন্নাথদেব তো বলভদ্র আর সুভদ্রাকে সঙ্গে নিয়ে মহা সমারোহে চলে গিয়েছিলেন মাসির বাড়ি অর্থাৎ গুণ্ডিচা মন্দিরে। সেখানে কটাদিন কাটল সমূহ আদর-যত্নে। কিন্তু এর মধ্যেই যে একটা গোলমাল বাধিয়ে ফেলেছেন স্বয়ং প্রভু জগন্নাথ। মাসির বাড়ি তিনি নিয়ে যাননি স্ত্রীকে অর্থাৎ দেবী লক্ষ্মীকে (Lord Laxmi)। এইবার যখন ঘরে ফেরার পালা, অর্থাৎ পুনর্যাত্রা অন্তে যখন রত্নবেদীতে পুনরায় অধিষ্ঠিত হবেন রাজাধিরাজ জগন্নাথ, তখন এই অপূর্ব লীলার সূচনা। হয়তো জেনেবুঝেই গোলমালটা বাধিয়েছিলেন জগন্নাথদেব, নয়তো দাম্পত্যের লীলা থেকে যে বঞ্চিত হবেন ভক্তরা। অথবা ভক্তেরাই প্রভু জগন্নাথের দাম্পত্যলীলা আস্বাদনের নিমিত্ত হয়তো প্রশ্রয় দিয়েছেন এই বিষয়টিকে। সে যাই হোক, আমরা দেখি, মাসির বাড়ি থেকে ফিরলেও সহজে কিন্তু জগন্নাথদেব মূল মন্দিরে প্রবেশের অনুমতি পান না। কেননা মানিনী হয়েছেন স্বয়ং মা লক্ষ্মী। অগত্যা তিন ভাই বোন শ্রীমন্দিরের সামনে তিনদিন ধরে রথের উপরেই উপবিষ্ট থাকেন। এই তিনদিন একাধিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সমাপ্ত হয় রথযাত্রা উৎসব। আর এই অবকাশেই দাম্পত্যের চিরমধুর এক আখ্যানের সাক্ষী থাকেন ভক্তরা।
তৃতীয় দিন জগন্নাথ (Lord Jagannath), বলরাম ও সুভদ্রা মন্দিরে প্রবেশ করতে গেলে ঘটে এক মজার কাণ্ড। বলরাম আর সুভদ্রার কপাল ভাল বলতে হবে। ভালয় ভালয় তাঁরা মন্দিরে প্রবেশ করেন। এদিকে তাঁদের পথ অনুসরণ করে যেই না জগন্নাথ ঢুকতে যাবেন, লক্ষ্মী দেবী সটান মুখের উপর দুম করে দরজা বন্ধ করে দেন। কারণ তিন ভাইবোন মাসির বাড়ি থেকে দেদার আমোদ-আহ্লাদ করে এসেছেন অথচ তাঁকে নিয়ে যাননি। অভিমানিনী লক্ষ্মী দেবী এই কয়দিন একা একা শ্রীমন্দিরে ছিলেন। অবশ্য মাঝখানে একদিন তিনি মাসির বাড়ি দেখা করতে গিয়েছিলেন কিন্তু জগন্নাথ তাঁকে যেন দেখেও দেখেননি। তারই ফলস্বরূপ যাত্রা শেষে জগন্নাথদেব দেখেন তাঁর জন্য বাড়ির দরজা বন্ধ। অবস্থা বেগতিক দেখে স্ত্রীর মানভঞ্জনের জন্য বুদ্ধি করে এক হাঁড়ি রসগোল্লার আয়োজন করে জগন্নাথ। ভাবখানা এই যে, যদি রসগোল্লার কল্যাণে অন্তত লক্ষ্মীদেবীর মান ভাঙে, তবে তিনি মন্দিরে প্রবেশের অনুমতি পান। যিনি জগদীশ্বর, যাঁর প্রকাশ এই গোটা পৃথিবী, তিনি নিজেই নিজেকে যেন লিপ্ত করেন এই সাধারণ মানবলীলায়। এই ছোট দুঃখ ছোট সুখের ভিতর দিয়ে ভগবান যেন জীবনের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম আনন্দমধুর মুহূর্তগুলিকে চিহ্নিত করে রাখেন। সেই লীলারই এবার সমাপ্তি। ত্রিভুবনের অতুল ঐশ্বর্যের অধিকারিণী দেবী লক্ষ্মীর মান ভাঙে ওই রসগোল্লা খেয়েই। পরিতৃপ্ত হয়ে অবশেষে স্বামীকে ঘরে ঢোকার অনুমতি দেন তিনি। খুশি মনে পতিদেবকে নিয়ে তিনি প্রবেশ করেন শ্রীমন্দিরে। এক বছরের মতো নিশ্চিন্ত, আর পতিদেব কাছছাড়া হবেন না। মন্দিরের সিংহদুয়ার এরপর বন্ধ হয়ে যায়।
আরও শুনুন: শ্রীমন্দিরে অপূর্ব লীলা, জগন্নাথের সঙ্গে কেন থাকেন দেবী বিমলা?
আষাঢ় মাসের শুক্লা ত্রয়োদশীতে নীলাদ্রি বিজয় উৎসবের অন্যতম উল্লেখযোগ্য ‘রসগোল্লা উৎসব’। ত্রয়োদশীর দিন ভোগ হিসাবে জগন্নাথদেবকে কয়েকশো হাঁড়ি রসগোল্লা নিবেদন করা হয়। আসলে এই মিষ্টি উপহার দেওয়া হয় লক্ষ্মীদেবীকেই। লক্ষ্মীর মান ভাঙিয়েই তো ঘরে ফিরতে হবে প্রভু জগন্নাথকে। ত্রয়োদশীতে তাই রসগোল্লা উৎসবে মেতে ওঠে ওড়িশা। প্রতিবছর দাম্পত্যের এই মধুররসের সাক্ষী থাকে আপামর জনসাধারণ আর তা অনুষ্ঠিত হয় লক্ষ্মীদেবী ও জগন্নাথদেবের সেবাইতদের মাধ্যমে। বাঙালির এই প্রাণের মিষ্টি রসগোল্লাতেই প্রতিবছর রথযাত্রার মধুরেণ সমাপয়েৎ হয়ে থাকে। অর্থাৎ, মিষ্টিমুখে রথযাত্রা সমাপন।খেয়াল করলে দেখা যাবে, এই রসগোল্লা কিন্তু ওড়িশা (Odissa) এবং বাংলার আপন আপন সংস্কৃতির অন্যতম স্মারক। প্রভু জগন্নাথের রথযাত্রা বাংলাতেও সমানভাবে আদৃত। মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের কল্যাণে, এই বঙ্গভূমে অন্তত রথযাত্রার মাহাত্ম্য আলাদা। শুধু যথাযোগ্য মর্যাদায় রথের অনুষ্ঠানই নয়, রথযাত্রা দুই প্রদেশ মানুষের আনাগোনা ও সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের একটি সূত্রও বটে। তারই একটি দিকচিহ্ন কি এই রসগোল্লা উৎসব? কেননা বাংলা ও ওড়িশা- দুই জায়গাতেই রসগোল্লা একটি উল্লেখযোগ্য খাদ্য শুধু নয়, বলা যায় দুই জায়গারই পরিচয়ের চিহ্ন বহন করে এই মিষ্টান্নটি। ভক্তবৃন্দ তাই যেন প্রভুর মানভঞ্জন পালায় টেনে এনেছে এই সমাদৃত মিষ্টান্নটিকেই।
আমরা তো জানি, জগন্নাথদেব স্বয়ং ভারতবর্ষের ধর্মীয় সংস্কৃতির মোহনাস্বরূপ। তাঁর উৎসবে তাই বহুতর সাংস্কৃতিক মিলনের চিহ্ন-ই যে ছড়িয়ে থাকবে, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। রসগোল্লা উৎসবকে আমরা সেই বহুবিধ সমন্বয়ের একটি রূপ হিসাবেই দেখতে পারি। আর তখনই যেন পৌঁছাতে পারি ঋষিকবির সেই অনুভবে- ‘অরূপ তোমার রূপের লীলায়/ জাগে হৃদয়পুর/আমার মধ্যে তোমার শোভা /এমন সুমধুর’। সুমধুর এই লীলারসের পরত যত খোলে বিস্ময়সমুদ্র ততই যেন উদ্বেল হয়ে উদ্ভাসিত হয় আমাদের হৃদয়পুরে।