আজ রথযাত্রার শুভারম্ভ। কথামৃত তাই শুরু করলাম বলরাম-সুভদ্রা-জগন্নাথদেবকে প্রণাম করে। আষাঢ় মাসের শুক্ল পক্ষে দ্বিতীয়া তিথিতে শুরু হয় রথযাত্রা। এই পুণ্যক্ষণে আমাদের জগন্নাথবন্দনা।
নীলাচল-নিবাসায়নিত্যায়পরমাত্মনে৷
বলভদ্র-সুভদ্রাভ্যাংজগন্নাথায়তেনমঃ৷৷
শাস্ত্রে বলা আছে, ‘রথস্থবামনংদৃষ্টাপুনর্জন্মনবিদ্যতে’ – অর্থাৎ, রথের উপর উপবিষ্ট জগন্নাথদেবকে যিনি দর্শন করেন, তাঁর আর পুনর্জন্মের ভাবনা থাকে না। এই পুণ্যতিথিতে মন্ত্রোচ্চারণ, আখ্যানবর্ণনের মধ্য দিয়ে আমরা জগন্নাথ দর্শনের অনির্বচনীয় অনুভবটুকু ভাগ করে নেব সকলের সঙ্গে।
প্রথমেই মন্ত্রোচ্চারণ করে প্রণাম নিবেদন করি শ্রী শ্রী প্রভু জগন্নাথদেবের প্রতি,
ওঁ পীনাঙ্গং দ্বিভূজং কৃষ্ণং পদ্মপত্ত্বায়-তেক্ষণমৃ৷ মহোরসং মহাবাহুং পীতবস্ত্রং শুভাননম্। শঙ্খ-চক্রগদাপাশিং মুকুটাঙ্গদভূষণম্। সৰ্ব্বলক্ষণসংযুক্তং বনমালাবিভূষিতম্ ॥ দেবদানবগন্ধৰ্ব্বযক্ষ-বিদ্যাধরোরগৈঃ। সেব্যমানং সদা দারুং কোটিসূৰ্য্যসমপ্ৰভম্। ধ্যায়েন্নারায়ণং দেবং চতুৰ্ব্বৰ্গফলপ্রদম্॥
এবার প্রণাম করি বলভদ্রকে,
ওঁ বলঞ্চ শুভ্রবর্ণাভং শরদিন্দুসমপ্রভমৃ। কৈলাসশিখরাকারং ফণাবিকটবিস্তরম্॥ নীলাস্বরধরঞ্চোগ্রং বলং বলমদোদ্ধতম্। কুণ্ডলৈকধরং দিব্যং মহামুষলধারিণম।
মহাবলং হলধরং রোঁহিণেয়ং বলং প্রভুম।
অনন্তর প্রণাম ও ধ্যান সুভদ্রাকে,
ওঁ সুভদ্রাং স্বর্ণপদ্মভাং পদ্মপত্রায়তেক্ষণামৃ। চিত্ৰ-বস্ত্রসমাচ্ছন্নাং হারকেয়ূরশোভিতাম্। বিচিত্রাভরণোপেতাং মুক্তাহারবিলম্বিতাম্। পীনোন্নতকুচাং রম্যাং সাধ্বীং প্রকৃতিরূপিকাম্। ভুক্তিমুক্তিপ্রদাত্রাঞ্চ ধ্যায়েত্তামস্বিকং পরাম্ ॥
আরও শুনুন : Spiritual: চন্দ্র-সূর্য তো মানুষের সেবায় ব্রতী, তারা কোন সম্প্রদায়ের?
কৃষ্ণযর্জুবেদিয় শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে ঈশ্বরের স্বরূপ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হয়েছে,
অপাণিপাদো জাবানো গ্রহীতা
পশ্যত্যচক্ষুঃ স শৃণোত্যকর্নঃ ।
স বেত্তি বেদ্যং ন চ তস্যাস্তি বেত্তা
তমাহুরগ্র্যং পুরুষং মহান্তম্’’ ।।
অর্থাৎ, যাঁর হাত নেই, তবু সকল জিনিস তিনি গ্রহণ করেন। যাঁর পা নেই, তবু সর্বত্র জুড়েই তাঁর চলাচল। যাঁর চোখ নেই তবু দেখেন সবই, কান নেই, তবু তাঁর কর্ণগোচর হয় না এমন কিছুই নেই। তিনিই বিশ্বাত্মা। বলা হয়, শাস্ত্রকারের এই কল্পনারই বাস্তব মূর্তি শ্রী জগন্নাথ দেব, বলভদ্র ও সুভদ্রা।
জগন্নাথ দেবের মূর্তি নির্মাণ নিয়ে একাধিক পৌরাণিক কাহিনি শুনতে পাওয়া যায়।সেরকমইএকটি কাহিনি অনুযায়ী,
স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ ভক্ত রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নকে আদেশ দেন যে, পুরীর সমুদ্রতটে ভেসে আসা একটি কাষ্ঠখণ্ডদিয়েরাজা যেনতাঁর একটা মূর্তি নির্মাণ করেন। ভগবানের আদেশে রাজা মূর্তি তৈরির জন্য কারিগরের খোঁজ শুরু করলেন। কিন্তু কাউকে আর পাওয়া যায় না। শেষমেশ এক বৃদ্ধ কারিগর রাজি হলেন মূর্তি নির্মাণে। তবে, দিলেন শর্তও। যে, তাঁর কাজের সময় কেউ যেন বিরক্ত না করে। দরজা বন্ধ করে কাজ শুরু করলেন বৃদ্ধ শিল্পী। দিন যায় রাত যায়। ভিতর থেকে শুধু খোদাইয়ের আওয়াজ ভেসে আসে। এইভাবে বেশ কিছুদিন পেরিয়ে যায়। একদিন আওয়াজ বন্ধ থাকায় রানি আর কৌতূহল সামলাতে না পেরে দরজা খুলে ফেলেন। দেখেন, মূর্তির নির্মাণ তখনও সম্পূর্ণ হয়নি। আর সেই বৃদ্ধ শিল্পী অন্তর্হিত হয়েছেন। এই শিল্পীই স্বয়ং বিশ্বকর্মা। রানি যখন এমন কাজের জন্য অনুতপ্ত, তখন সেখানে এসে উপস্থিত হন নারদ। বলেন, এই অর্ধসমাপ্ত মূর্তিই পরমেশ্বরের একটি রূপ। এরই যেন পূজা করা হয়। এইভাবেই শুরু হল জগন্নাথদেবের পূজা।
অপর এক কিংবদন্তিতে পাওয়া যায়, গোপীদের কৃষ্ণপ্রীতির কথা শুনে জগন্নাথ ও বলরামের মুখের যে রূপ হয়েছিল, তাই-ই ফুটে উঠেছেএই বিগ্রহে।
আর একটি পৌরাণিক কাহিনিও শোনা যায়। স্বয়ং কৃষ্ণ যখন দেহরক্ষা করেন, তখন বেশ কিছুদিন যাবৎ জ্বলতে থাকে তাঁর চিতা। সেই চিতাভস্ম একটা সময় ভাসিয়ে দেওয়া হয় জলে। যা পরে কাঠের রূপ নিয়ে ভেসে আসে পুরীর সমুদ্রতটে। সেই কাঠেই তৈরি হয় বিগ্রহ। এটিকেই আবার বলা হয় ‘ব্রহ্মবস্তু’। জগন্নাথ দেবের বিগ্রহকে ‘দারুব্রহ্ম’ নামেও অভিহিত করা হয়। নিম কাঠের তৈরি এই বিগ্রহ কয়েক বছর বাদে বাদেই বদলে ফেলা হয়। শুধু অবিকৃত থেকে যায় এই ব্রহ্মবস্তুটি। কৃষ্ণা চতুর্দশীর মধ্যরাতে পুরীর সব আলো নিভিয়ে এই ব্রহ্মবস্তু স্থাপন করা হয় নব কলেবরে। চারজন প্রবীণ দৈতাপতি চোখ বাঁধা অবস্থায় এই ব্রহ্মবস্তুটি ধারণ করেন এবং পুরনো বিগ্রহ থেকে তা নতুন বিগ্রহে স্থাপন করেন। বিগ্রহ পরিবর্তনের এই অনুষ্ঠানের নামই ‘নবকলেবর’, আর ব্রহ্মবস্তু স্থাপনের নাম ব্রহ্মপরিবর্তন।
রথযাত্রার দিন এই তিন বিগ্রহকে রত্নসিংহাসন থেকে তিনটি আলাদা রথে চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় গুণ্ডিচা মন্দিরে। জগন্নাথ দেবের রথটির নাম‘কপিধ্বজ’বা ‘নন্দীঘোষ’, দাদা বলরাম অধিষ্ঠান করেন ‘তালধ্বজ’ রথে। আর, ভগিনী সুভদ্রার রথটির নাম ‘দর্পদলন’। প্রতীকী ঘোড়া থাকলেও রথের রশি টানেন আগত পুণ্যার্থীরাই।
এই রথকে কখনও আমাদের দেহের সঙ্গেও তুলনা করা হয়। রথের গঠনের ভিতর তার ইঙ্গিত আছে। যেমন জগন্নাথদেবের রথের ষোলটি চাকা আমাদের দশ ইন্দ্রিয় ও ছয় রিপুর প্রতীক, এরকম মত পোষণ করেন কেউ কেউ। রথে ব্যবহৃত কাঠের সঙ্গেও আমাদের শারীরিক গঠনের যোগাযোগ আছে, এরকমটাও বলেন কেউ কেউ।
আরও শুনুন : Spiritual : শাস্ত্রমতে কে আসলে প্রকৃত ধার্মিক? কী তাঁর নিত্যকর্তব্য?
এই রথ উপলক্ষে যে ভক্তিপ্লাবনে ভাসে পুরীধাম, তার তুলনা মেলা ভার। এ যেন সমন্বয়ের এমন এক দৃশ্য, যা বছর বছর সাড়ম্বরে উদযাপন করে চলেছে আপামর ভারতবাসী। শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর ভারি প্রিয় ছিল এই রথযাত্রা। রথযাত্রার সময় ভাবে বিভোর হতেন মহাপ্রভু। চৈতন্যচরিতামৃত সে অবস্থার বর্ণনা করে বলেছেন,-
‘উদ্দণ্ড নৃত্যে প্রভুর অদ্ভুত বিকার।
অষ্ট সাত্ত্বিক ভাবোদয় হয় সমকাল।।
কভু স্তম্ভ কভু প্রভু ভূমিতে পড়য়।
শুষ্ককাষ্ঠসম হস্ত পদ না চলয়।’
বলা যায়, রথযাত্রা আজ যে এমন সার্বজনীন উৎসব হয়ে উঠেছে তা মহাপ্রভুর কারণেই। শ্রীমৎ শঙ্করাচর্যের রচিত জগন্নাথষ্টকম আবৃত্তি করেছিলেন মহাপ্রভু। তারই কিছু অংশ পাঠ করে আমরাও প্রণাম নিবেদন করব জগন্নাথদেবের প্রতি।
কদাচিত্কালিন্দীতটবিপিনসঙ্গীতকরবো
মুদাগোপীনারীবদনকমলাস্বাদমধুপঃ।
রমাশম্ভুব্রহ্মামরপতিগণেশার্চিতপদো
জগন্নাথঃস্বামীনয়নপথগামীভবতুমে॥১॥
ভুজেসব্যেবেণুংশিরসিশিখিপিংছংকটিতটে
দুকূলংনেত্রান্তেসহচরকটাক্ষংবিদধতে।
সদাশ্রীমদ্বৃন্দাবনবসতিলীলাপরিচয়ো
জগন্নাথঃস্বামীনয়নপথগামীভবতুমে॥২॥
মহাম্ভোধেস্তীরেকনকরুচিরেনীলশিখরে
বসন্প্রাসাদান্তস্সহজবলভদ্রেণবলিনা।
সুভদ্রামধ্যস্থস্সকলসুরসেবাবসরদো
জগন্নাথঃস্বামীনয়নপথগামীভবতুমে॥৩॥
…
হরত্বংসংসারংদ্রুততরমসারংসুরপতে
হরত্বংপাপানাংবিততিমপরাংয়াদবপতে।
অহোদীনানাথংনিহিতমচলংনিশ্চিতপদং
জগন্নাথঃস্বামীনয়নপথগামীভবতুমে॥৮॥
হে প্ৰভু জগন্নাথ দেব আমার নয়নপথগামী হউন। এই অসার সংসার থেকে, এই পাপভার হরণ করে আমাকে উদ্ধার করুন। আমাকে সঠিক পথনির্দেশ দিন। মানুষের এই নিবেদন, এই আর্তির অনুরণন শোনা যায় বলেই রথযাত্রা মহিমাময়। রথে উপবিষ্ট সেই সকল দেবতার দেবতাকে আমাদের ভক্তিপূর্ণ প্রণতি।