নন্দোৎসবের প্রচলিত এক লোকগান হল, ‘গোপালে পাইয়া ব্রজের কী আনন্দ হল, তালের বড়া খেয়ে নন্দ নাচিয়া উঠিল’। শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিনে ‘তালের বড়া’ খাওয়ার রীতি প্রচলিত রয়েছে। কিন্তু কৃষ্ণের প্রিয় খাবারের তালিকায় রয়েছে আরও অনেক কিছুই। বলা হয়, ‘গোপালকলা ভোগেই’ সবথেকে বেশি তুষ্ট হন তিনি। কী এমন বিশেষত্ব রয়েছে এই ভোগের? শ্রী কৃষ্ণের কত তম জন্মবার্ষিকী পালন করা হবে এবছর? আসুন শুনে নেওয়া যাক শ্রীকৃষ্ণ সম্পর্কিত কিছু জানা-অজানা তথ্য।
ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে শ্রীকৃষ্ণের জন্ম। জোতিষশাস্ত্র মতে কৃষ্ণের জন্মলগ্নে রোহিণী নক্ষত্রের যোগ ছিল। কংসরাজের কারাগারে মাতা দেবকীর কোল আলো করে জন্ম নেন শিশু শ্রীকৃষ্ণ। দেবকী ও বসুদেবের অষ্টম গর্ভের সন্তান শ্রীকৃষ্ণ, জন্মলগ্ন থেকেই সম্মুখীন হয়েছেন নানান ভয়ানক বিপদের। কংসের হাত থেকে সন্তানকে রক্ষা করার জন্য জন্মের পরই শিশু কৃষ্ণকে নিয়ে বৃন্দাবনের গোকুল গ্রামে চলে যান বসুদেব। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে যমুনা নদী পার করার সময় শিশু কৃষ্ণের উপর ছাতা হয়ে দাঁড়িয়েছিল স্বয়ং নাগরাজ বাসুকি। সবার অগোচরেই নন্দরাজের ঘরে কৃষ্ণকে রেখে এসেছিলেন বসুদেব। তাই গোকুলবাসীর কাছে কৃষ্ণ ছিলেন যশোদা ও নন্দের পুত্র। ছোটবেলায় তাঁকে সবাই আদর করে গোপাল বলে ডাকত। তাই ঘরে ঘরে এই দিন শ্রীকৃষ্ণ বা গোপাল পূজার আয়োজন করা হয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এই কৃষ্ণ জন্মাষ্টমীকে কৃষ্ণাষ্টমী, গোকুলাষ্টমী, অষ্টমী রোহিণী, শ্রীকৃষ্ণজয়ন্তী এবং শ্রীজয়ন্তীও বলা হয়।
আরও শুনুন: শিবভক্তির সামনে থমকে গিয়েছিলেন যমও, ঋষি মার্কণ্ডেয়র কাহিনি দেয় অমরত্বের সন্ধান
‘কৃষ্ণ’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ কালো। আবার অন্যত্র, কৃষ্ণকে নীল মেঘের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। ইতিহাসবিদদের বিবেচনায় ১০০০-৯০০ খ্রিস্টপূর্বে সনাতন ধর্মের প্রাণপুরুষ শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব ঘটে। তাঁর জন্মের সময় এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড পাপ ও অরাজকতায় পরিপূর্ণ ছিল। তাই মানব জাতিকে রক্ষার জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব ঘটে। নানা ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে শ্রীকৃষ্ণ মানবজাতির কাছে জীবন ধারণের অনন্য উদাহরণ রেখে গেছেন। পঞ্জিকা মতে, ২০২২ সালে শ্রীকৃষ্ণের ৫২৪৮তম জন্মবার্ষিকী পালন করা হবে। কারণ, বিভিন্ন পুরাণ ও প্রাচীন গ্রন্থ মতে, দ্বাপরযুগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ১২৫ বছর মর্ত্যধামে কাটিয়েছেন। মাঘ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে তিনি ইহধাম ত্যাগ করেন। আবার সেই দিনটিকেই কলিযুগের সূচনাকাল হিসেবে ধরা হয়। খ্রিস্টপূর্ব ৩১০১ সালে কলিযুগ আরম্ভ হয়। বর্তমান ২০২২ খ্রিস্টাব্দ। সুতরাং কলিযুগ স্থায়ী রয়েছে ৫১২৩ বছর ধরে। শ্রীকৃষ্ণের অর্ন্তধানের দিনই কলিযুগের আবির্ভাব। অর্থাৎ সেই হিসাব অনুযায়ী শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব হয়েছিল ৫২৪৮ বছর পূর্বে।
আরও শুনুন: নাগপঞ্চমী পালনে তৃপ্ত হন মহেশ্বরও, পুরাণমতে কীভাবে শুরু হল এই উৎসব?
এই হিসেবের কথা অবশ্য মনে রাখেন না আপামর দেশবাসী। তাঁদের কাছে গোপাল চিরকালই শিশুর প্রতিরূপ। অনেকেই বাড়ির সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে গোপালকে পুজো করেন। এমনকী অনেক নিঃসন্তান মানুষের কাছেও গোপালের মূর্তি সন্তানসম। সন্তানের পছন্দের খাবার প্রস্তুতি যেমন তার বাবা-মা ব্যস্ত থাকেন গোপালের ভোগ নিয়েও তেমনই উন্মাদনা দেখা যায় সবার মধ্যে। ভোগের সেই তালিকায় সবার উপরেই থাকে ‘গোপালকলা ভোগ’। নারকেল কোরার সঙ্গে ভিজিয়ে রাখা চাল ও বিভিন্ন ফল মিশিয়ে প্রস্তুত করা এই ভোগ-ই নাকি গোপালের সবথেকে প্রিয় ভোগ। পাশাপাশি থাকে নাড়ু। নাড়ু খেতে ভালোবাসেন বলে অনেকে আবার গোপালকে ‘নাড়ুগোপাল’ বলেও ডাকেন। পাশাপাশি তালের বড়া, ক্ষীর, মালপোয়া, রাবড়ি এই সব কিছুই গোপালের অত্যন্ত পছন্দের খাবার। তবে ছোটথেকেই গোয়ালার ঘরে বড় হয়েছেন কৃষ্ণ। গোকুল গ্রামবাসীর প্রধান জীবিকাও ছিল গো-পালন। তাই মাখন খেতে ভীষণ পছন্দ করতেন কৃষ্ণ। তাঁর বাল্যলীলাগুলির মধ্যে মাখন চুরি করে খাওয়ার ঘটনাও বেশ জনপ্রিয়। অনেকেই গোপালকে মাখন-মিছরির ভোগও নিবেদন করে থাকেন। সর্বোপরি ভারতীয়দের ঘরে ঘরে গোপাল দেবতা অপেক্ষা সন্তানরূপেই বেশি ধরা দিয়েছেন, তাই তাঁর জন্মদিনে ভালোবেসে যা দেওয়া হয় তাকেই ভোগ হিসেবে গ্রহণ করেন তিনি। তাই জন্মাষ্টমী তিথিতি সন্তানরূপে গোপালের পূজা করলে অনিষ্ট দূর হয়। ভালোবাসা, শান্তি ও সমৃদ্ধিতে ভরে ওঠে গেরস্থালী।