স্বামীর মঙ্গল কামনায় সূর্যের পুজো করেছিলেন পুরাণের বেশ কিছু চর্চিত নারী চরিত্র। তাই রামায়ণ ও মহাভারত দুই জায়গাতেই ‘ছট পুজোর’ উল্লেখ পাওয়া যায়। এই পুজোর প্রধান আরাধ্য সূর্যদেব। আর সেই সূর্যের ‘ছটা’ থেকেই নাকি এর নাম হয়েছে ‘ছটপুজো’। সুপ্রাচীন এই উৎসবের সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবেই জড়িয়ে রয়েছে নানান কিংবদন্তি। আসুন, শুনে নিই।
গ্রিক, রোমান বা মিশরীয় সভ্যতার মতোই ভারতীয় পুরাণেরও অন্যতম প্রধান দেবতা হলেন সূর্য। ঋগ্বেদের শ্লোকেও সূর্যবন্দনার উল্লেখ রয়েছে। এমনকি যে কোনও পুজোর শুরুতেই সূর্যদেবকে অর্ঘ্য দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। তবে নিত্যপূজার পাশাপাশি কার্তিক মাসের শুক্লাষষ্ঠীতে আয়োজন করা হয় বিশেষ সূর্যবন্দনার। সারা দেশের কাছে যা ছট-উৎসব নামে পরিচিত।
আরও শুনুন: অমরত্ব কি অভিশাপ? পৌরাণিক কাহিনিতেই আছে সেই ইঙ্গিত
মূলত পূর্বভারতের বিহার প্রদেশের প্রধান উৎসব হিসেবে বিবেচনা করা হয় ছটপুজোকে। তবে বর্তমানে ছট-পুজোও সামগ্রিক ভাবে গোটা দেশের উৎসবেই পরিণত হয়েছে। শোনা যায়, সূর্যের কিরণ বা ছটার অপভ্রংশ হয়েই ‘ছট’ শব্দটির উৎপত্তি। আবার অনেকের মতে, ‘ছট’ শব্দটি এসেছে ষষ্ঠী থেকে। এই নিয়ে বিতর্ক থাকলেও ছট পুজোর সূচনা নাকি মহাভারতের আমলেই হয়েছিল। বলা হয়, পঞ্চপাণ্ডবের রাজ্যজয়ের বর চেয়ে তাঁদের স্ত্রী দ্রৌপদী সূর্যদেবের আরাধনা করেছিলেন। আবার প্রতিদিন এক কোমর জলে দাঁড়িয়ে সূর্যকে অর্ঘ্য নিবেদন করতেন সূর্যপুত্র কর্ণ। সেই রীতি মেনেই ছটপুজোতেও অর্ঘ্য নিবেদনের প্রচলন রয়েছে। মহাভারতের পাশাপাশি রামায়ণেও উল্লেখ পাওয়া যায় এই বিশেষ পুজোর। কথিত আছে, ১৪ বছর বনবাস কাটিয়ে অযোধ্যায় ফেরার পর রাবণবধের পাপ থেকে মুক্তি পেতে রাজসূয় যজ্ঞ করার সিদ্ধান্ত নেন রামচন্দ্র ও সীতা। এর জন্য মুদগল ঋষিকে আমন্ত্রণ জানান অযোধ্যাপতি। কিন্তু ঋষি তাঁদের নিজের আশ্রমে ডেকে পাঠান। এবং ঋষি মুদগল রাম-সীতাকে কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে সূর্যদেবের উপাসনার নির্দেশ দেন। সেখানেই সীতা ৬ দিনের সুর্যপুজো সম্পন্ন করেন।
আরও শুনুন: ১১৫ ফুট মন্দির তৈরি হল রাতারাতি, ‘ভূতের মন্দির’ এখনও শিহরিত করে পর্যটকদের
সেই ধারা বজায় রেখেই দেশজুড়ে সাড়ম্বরে পালন করা হয় ছটপুজো। পৃথিবীতে জীবনের স্রোত অবিরাম রাখার জন্যই নাকি সূর্যকে এই পুজোর মাধ্যমে উপাসনা করা হয়। তবে শুধুমাত্র সূর্যদেব নন, এই পুজোর অন্যতম অংশ হিসেবে পূজিতা হন তাঁর স্ত্রী ঊষা দেবীও। অনেকেই তাই ছটপুজোর ক্ষেত্রে ‘ছটি মাইয়া’র প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন। তবে এই পুজোর নিয়ম অন্যান্য যে কোনো পুজোর থেকে বেশ কঠিনই বলা চলে। নিয়ম অনুসারে টানা তিনদিন ধরে প্রায় নির্জলা উপবাস করতে হয় ব্রতীদের। চতুর্থদিনে সূর্যদেবকে অর্ঘ্য প্রদান করে সম্পন্ন হয় এই পুজো। এই দিন সকাল বেলা সূর্যোদয়ের সময় ছট ব্রতীরা তাঁদের পরিবারের সঙ্গে গঙ্গার বা কোনও পুকুর ঘাটে গিয়ে সূর্যদেবকে অর্ঘ্য নিবেদন করে ছট উপবাস ভঙ্গ করেন। তারপর রাজকীয় আয়োজনের সঙ্গে রীতিমতো বাজি পুড়িয়ে গান চালিয়ে ছট পুজোর প্রসাদ নিয়ে ঘরে ফেরেন তাঁরা। প্রাচীন সূর্য উপাসনার রীতিই যে ছট-উৎসবের মূল কথা, তা বলাই যায়।