শ্রীজগন্নাথ মহাপ্রভু জগতের নাথ। তাঁর মধ্যেই তাই সমন্বয় সমস্ত ধর্ম, দর্শন ও মতের। তিনি কোনও নির্দিষ্ট ধর্ম বা জাতির দেবতা নন, বরং তিনি গণধর্মের গণদেবতা। তিনি গাণপত্যের গণপতি, বৈষ্ণবের বিষ্ণু, শিবের শিব, শাক্তর শক্তি, বৌদ্ধর বুদ্ধ, সৌরর সূর্য। সনাতন ধর্মের প্রায় সমস্ত সম্প্রদায় জগন্নাথ মহাপ্রভুর মধ্যেই নিজের ইষ্টদেবকে খুঁজে পেয়েছেন। আর তাই দেখা যায়, এই স্নানযাত্রার পুণ্যলগ্নে ভক্তদের প্রভু দর্শন দেন গজানন রূপেও। লিখলেন অরিঞ্জয় বোস।
শ্রীগীতায় জ্ঞানযোগে জগৎগুরু শ্রীকৃষ্ণ শিষ্য অর্জুনকে বলছিলেন- ‘যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে, তাংস্তথৈব ভজাম্যহম।’ আক্ষরিক অর্থ পেরিয়ে এ-উক্তির সারার্থ আমাদের জানায়, ভক্ত যেভাবে ভগবানের আরাধনা করেন, ভগবানও ঠিক সেভাবেই তাঁকে কৃপা করেন। এই শ্লোকের পরের অংশটিও প্রণিধানযোগ্য – ‘মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশঃ’ – অর্থাৎ মানুষ যে-পথ ধরেই তাঁর দিকে যাত্রা শুরু করুক না কেন, অন্তিমে তাঁর কাছে পৌঁছায়, তাঁকেই লাভ করেন। প্রভু জগন্নাথের ক্ষেত্রেও ভগবান কৃষ্ণের এই উক্তিটি বিশেষ ভাবে প্রাসঙ্গিক। শ্রীজগন্নাথ মহাপ্রভু জগতের নাথ। তাঁর মধ্যেই তাই সমন্বয় সমস্ত ধর্ম, দর্শন ও মতের। তিনি কোনও নির্দিষ্ট ধর্ম বা জাতির দেবতা নন, বরং তিনি গণধর্মের গণদেবতা। তিনি গাণপত্যের গণপতি, বৈষ্ণবের বিষ্ণু, শিবের শিব, শাক্তর শক্তি, বৌদ্ধর বুদ্ধ, সৌরর সূর্য। প্রত্যেক ধর্মমতের মানুষ নিজের ইষ্টদেবতার স্বরূপ উপলব্ধি করেছেন তাঁর ভিতরই। সনাতন ধর্মের প্রায় সমস্ত সম্প্রদায় জগন্নাথ মহাপ্রভুর মধ্যেই নিজের ইষ্টদেবকে খুঁজে পেয়েছেন। আর তাই দেখা যায়, এই স্নানযাত্রার পুণ্যলগ্নে ভক্তদের প্রভু দর্শন দেন গজানন রূপেও।
জগন্নাথ প্রভুর এই অপূর্ব লীলামাধুরী প্রকাশের ক্ষণটি হল স্নানযাত্রার পুণ্যলগ্ন। শ্রীজগন্নাথের আর-এক নাম লীলাপুরোষোত্তম। লীলার মাধ্যমেই ভক্তদের সঙ্গে তাঁর ভাবের আদানপ্রদান। চিন্তাধারার জাগরণ সম্ভব করে তোলেন স্বয়ং ভগবান। লীলার যে-মাধুর্য, তার প্রকাশ হয় যাত্রার মাধ্যমে। লীলায় যে-গভীর ভাব, দর্শন, জ্ঞান থাকে- সেগুলি যাত্রার মাধ্যমে সহজ আর সহজভাবে পরিস্ফুট হয়। সেই লীলা প্রসঙ্গে পৌঁছনোর আগে আমরা অতিক্রম করব স্নানযাত্রার পর্বটি।
স্নানযাত্রার আয়োজন মনোরম। পবিত্র স্নান-পূর্ণিমায় রত্ন সিংহাসন থেকে নেমে আসেন প্রভু জগন্নাথ, সুভদ্রা ও বলরাম। স্নানবেদীতে হয় মহাপ্রভুর প্রত্যক্ষ স্নান। অন্য সমস্ত দিন পরোক্ষ স্নান করেন রত্নবেদীতে আসীন ত্রিদেব। স্নানযাত্রার দিন জল আনা হয় ‘স্বর্ণ কুণ্ড’ থেকে। কুণ্ডটি শ্রীমন্দিরের ভেতরেই অবস্থিত। সুদর্শন ও ত্রিমূর্তি-কে ১০৮ কলসি জলে স্নান করানো হয়। ‘স্কন্দপুরাণ’-এ উল্লেখ রয়েছে, স্বয়ং শ্রীজগন্নাথ ইন্দ্রদ্যুম্ন মহারাজকে বলেছিলেন, ‘আমার আবির্ভাব দিবস জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমাতে আমাকে বাইরে, মণ্ডপের উপর নিয়ে গিয়ে ভক্তিভাবে আদর-যত্নে মহাস্নান করাবে।’ সেই আদেশ পালনের পরম্পরা এখনও প্রচলিত। জনশ্রুতি আছে, আগে এই উৎসবটির জন্যে ভারতের বিভিন্ন তীর্থস্থান থেকে পবিত্র জল আনা হত। বৈষ্ণব মতে ঠাকুরের যাত্রার আগে তাঁর রাস্তা পরিষ্কার করার জন্য ঝাড়ু দেওয়া হয়। মহাপ্রভু জগন্নাথের প্রথম সেবক হিসেবে পুরীর মহারাজ ঠাকুরের জন্য রাস্তা পরিষ্কার করেন। এই একই প্রথা আমরা দেখতে পাই রথযাত্রা ও উল্টোরথের সময়। মহাপ্রভু আসীন হওয়ার পর চতুর্ধা মূর্তি স্নান করেন।
স্নানযাত্রার শেষ পর্বে আসে সেই বিশেষ ক্ষণ, যখন গজানন বেশে ভক্তদের দর্শন দেন ভক্তের ভগবান। কেন তাঁর এই বেশ ধারণ? এইখানে আমরা গীতা স্মরণ করতে পারি, যে, ভগবান তো তাঁর ভক্ত যেভাবে ভজনা করছেন সেভাবেই অনুগ্রহ করবেন, আশীর্বাদ করবেন। ভক্তের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেন বলেই তো তিনি ভক্তবাঞ্ছাকল্পতরু। এক ভক্তের বাসনা পূরণ করতেই তাই প্রভু জগন্নাথের এহেন লীলার প্রকাশ। দক্ষিণ ভারতে গণপতি ভট্ট নামে সিদ্ধিদাতা গণেশের এক পরম ভক্ত ছিলেন। তিনি শুনেছিলেন, শ্রীধাম পুরীতেই আছেন তাঁর ইষ্টদেবতা। আরাধ্যকে দর্শন করার জন্যে তিনি একদিন পৌঁছে গেলেন পুরীর মন্দিরে। গর্ভগৃহে প্রবেশ করে ভক্তপ্রবর রত্ন-সিংহাসনে শ্রীজগন্নাথ দেবকে চাক্ষুষ করলেন। কিন্তু সিদ্ধিদাতা গণেশকে দেখতে না-পেয়ে দুঃখপূর্ণ হৃদয়ে অনেক অভিমান নিয়েই তিনি পুরী ত্যাগ করলেন। ভক্তের মনের কথা আর ভগবানের অগোচর থাকে কী করে! ফেরার পথে মাঝরাস্তায় স্বপ্নে তাই পেলেন গণপতিকে। আবার তিনি ফিরে এলেন শ্রীক্ষেত্রে। এবারই হল তাঁর দর্শন। পূর্ণ হল আজীবনের সাধ। জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমার দিন স্নান-মণ্ডপে শ্রীজগন্নাথ আর বলরামকে অপূর্ব শোভামণ্ডিত কালো আর সাদা বেশে নিজের ইষ্টদেব সিদ্ধিদাতাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। মহাপ্রভু তাঁকে গণপতি রূপে দর্শন দিলেন।
ঐতিহাসিক তথ্যানুসারে, এই গজানন বেশ আরম্ভ হয় মারাঠা শাসনের সময়। মারাঠাদের আরাধ্য দেবত হলেন সিদ্ধিবিনায়ক গণেশ। তাই হয়তো তিনি বছরে একবার এই বিশেষ রূপ ধারণ করেন। এ-ও এক সমন্বয়ের সূত্র। ধর্ম যে অর্থে এবং যেভাবে আমাদের ধারণ করে, আমাদের সভ্যতাকে ধারণ করে তার চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে, এই সমন্বয়-সূত্র থেকেই আমরা তার স্বরূপ এবং আদলটি আবিষ্কার করতে পারি। শুধু গণপতির ভক্তদের মনোবাসনা পূর্ণ করাই নয়, এই বিশ্বাস বরাবর প্রমাণিত, যে, ভক্ত যে-রূপে জগন্নাথ দেবকে দেখতে চেয়েছেন, সেই রূপে তাঁকে দর্শন দিয়েছেন নিভৃত প্রাণের দেবতা। রামানুজ তুলসীদাসকে শ্রীরাম, শ্রীচৈতন্যকে শ্রীকৃষ্ণ, তোতাপুরীকে দক্ষিণাকালী রূপে যেমন দর্শন দিয়েছিলেন, সেভাবেই গণপতি ভট্টের মানসলোকে ধরা দিয়েছিলেন সিদ্ধিদাতা রূপে।
ভক্তকুলকে দর্শন দিয়ে, স্নানান্তে অসুস্থ হওয়ার মতো আরও একটি লৌকিক সত্যকে গ্রহণ করে জগন্নাথ মহাপ্রভু ১৪ দিনের জন্যে লোকচক্ষুর আড়ালে নিভৃতবাস যাপন করেন। এরপর জগতের নাথ নামকে সার্থক করে মহাপ্রভু নেমে আসেন রাস্তায়, রথে বসে জনতা জনার্দনের সঙ্গে একাকার হয়ে যান। সে এক আনন্দময় মিলনক্ষেত্র। সে-কথা অন্যত্র, তবে এই পরিসরে এটুকুই আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে, জগন্নাথ দেব এই পৃথিবীতে এক অপূর্ব সমন্বয়ের প্রতীক। ভক্তের বিশ্বাস অনুযায়ী তাই ভগবান স্বয়ং এখানে নিজেকে বদলে নেন। যে যেভাবে তাঁকে ভজনা করতে চান, মহাপ্রভু সেভাবেই তাঁকে দর্শন দেন। আসলে তো প্রবহমান সনাতন ধর্মের স্বচ্ছ স্রোতপ্রবাহে এভাবেই মিশেছে বহু সাধকের বহু সাধনার ধারা। প্রভু জগন্নাথ দেব যেন সেই আবহমানের তত্ত্বকথার মূর্ত প্রতীক। বহু মত, পথ লীন হয়ে যায় তাঁর চরণেই। আর জগতের সকলের মঙ্গলের জন্য তিনি জগতের নাথ জেগে থাকেন একা। মিলনেই যে যথার্থ মঙ্গল সূচিত হয়, জগন্নাথ প্রভু নিজের লীলামাধুরী