শুধুমাত্র পুরীর জগন্নাথ মন্দির নয়। রথযাত্রার সঙ্গে অঙ্গাগিভাবে যুক্ত, আরও একটি মন্দির। গুণ্ডিচা মন্দির। যা জগন্নাথের মাসির বাড়ি হিসেবেই পরিচিত। রথে চড়ে এখানেই উপস্থিত হন মহাপ্রভু। তারপর সাতদিন কাটিয়ে যান। নানা লোককথা ছড়িয়ে আছে এই গুণ্ডিচা মন্দির ঘিরে। আসুন শুনে নেওয়া যাক।
রথে চড়ে মাসির বাড়ি যাবেন জগন্নাথ। শ্রীমন্দিরে সাজো সাজো রব। তবে স্রেফ শ্রীমন্দির নয়, আরও এক মন্দির সেজে উঠছে রাজকীয় আয়োজনে। সেখানেই তো সাত দিন থাকবেন প্রভু। তাও আবার ঘরের ছেলে হয়ে। তাই গুন্ডিচা মন্দিরেও রথযাত্রার বহু আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় প্রস্তুতি।
আরও শুনুন: রথের রশি ছুঁলেই কাটে দুর্ভোগ! কী বিশেষত্ব পুরীর রথের?
গুন্ডিচা মন্দিরের দূরত্ব শ্রীমন্দির থেকে মাত্র ৩ কিলোমিটার। পুরীর রাজপথের দুই প্রান্তে অবস্থিত এই দুই মন্দির। সারা বছরই এখানে দর্শনার্থিদের ভিড় লেগে থাকে। তবে রথের সময় সেই ভিড় হয় চোখে পড়ার মতো। মন্দিরটি চারদিকে সুদৃশ্য বাগান দিয়ে ঘেরা। অনেকেই তাই এই মন্দিরকে জগন্নাথের বাগানবাড়ি বলে থাকেন। হালকা ধূসর বেলেপাথরে তৈরি এই মন্দিরে কলিঙ্গ স্থাপত্য শৈলীর উৎকৃষ্ট নিদর্শন ধরা পড়ে। মন্দিরের চারটি অংশ। একেবারে অন্দরে গর্ভগৃহ, যেখানে রথের সময় প্রভু জগন্নাথ অবস্থান করেন। বাইরে সমাবেশ দালান ও নাটমন্দির। এছাড়া রয়েছে একটি ভোগমণ্ডপ। বাগান ঘেরা এই মন্দিরের চারপাশে উঁচু পাঁচিল চোখে পড়ে। এছাড়া মন্দিরে দুটি ফটক রয়েছে। পশ্চিমপ্রান্তে অবস্থিত একটি বিশাল দরজা। এই দরজা দিয়েই জগন্নাথ মূর্তি রথে থেকে নামিয়ে গুন্ডিচা মন্দিরে প্রবেশ করানো হয়। এর ঠিক উলটোদিকে আরও একটি দরজা রয়েছে। পূর্বদিকের ওই দরজা দিয়েই ত্রিমূর্তিকে পুনরায় রথে তোলা হয়। তবে এই মন্দিরেই জগন্নাথের বেড়াতে আসার নেপথ্যে বেশ কিছু লোককাহিনি প্রচলিত রয়েছে।
আরও শুনুন: নীল বর্ণের জগন্নাথ, মহিলারাও অংশ নেন প্রভুর এই বিশেষ রূপের পুজোয়
যার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, রাজা ইন্দ্রদুম্ন্য ও তাঁর স্ত্রীর কথা। আসলে রাজার স্ত্রী-র নামই ছিল গুন্ডিজা। তাঁকে উদ্দেশ্য করেই এই মন্দির তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন অনেকেই। কথিত আছে দেব বিশ্বকর্মা যখন বন্ধ ঘরে জগন্নাথ মূর্তি তৈরি করছিলেন, গুন্ডিচাদেবী কোনওভাবে তা দেখে ফেলেন। এবং সেই অর্ধসমাপ্ত মূর্তি দেখেই তিনি মোহিত হয়ে রাজাকে অনুরোধ করেন আরও একটি মন্দির নির্মানের জন্য। এমনটাও শোনা যায়, রাণী গুন্ডিচাই প্রথম রথযাত্রার প্রচলন করে বছরের নির্দিষ্ট সময় জগন্নাথের সেবার অবকাশ পেতে চান। তাঁর কথা মতোই তৈরি হয় গুন্ডিচা মন্দির। অন্য একটি লোককথা যদিও একেবারে এই তথ্য দেয় না। সেখানে বলা হয়েছে, প্রভু জগন্নাথ গুন্ডিচা দেবীর মন্দির দেখে প্রসন্ন হয়েছিলেন। তাই বছরের সাতদিন করে এখানে কাটিয়ে যাওয়ার কথা দিয়েছিলেন। সেই থেকে নাকি রথযাত্রা এবং প্রভুর গুন্ডিচা মন্দিরে সাতদিন কাটানোর প্রচলন হয়েছে।
আরও শুনুন: শ্রীমন্দিরে অপূর্ব লীলা, জগন্নাথের সঙ্গে কেন থাকেন দেবী বিমলা?
তবে এছাড়াও কিছু লোকশ্রুতি ঘিরে রয়েছে পুরীর গুন্ডিচা মন্দিরকে। অনেকেই মনে করেন, এই মন্দির আসলে স্থানীয় এক দেবীর। তাঁর নামই গুন্ডিচা। মনে করা হয়, তিনি দেবী দুর্গার রূপ। ওড়িয়া ভাষায় গুটিবসন্ত রোগকে ‘গুন্ডি’ বলা হয়। এই দেবী গুণ্ডিচা আসলে সেই রোগ নিরাময়ের দেবী। এঁকেই কৃষ্ণ-জগন্নাথের মাসি হিসেবে অভিহিত করা হয়। যার বাড়িতে ত্রিমূর্তি বছরে সাতদিন কাটাতে আসেন। এইকদিন প্রভু জগন্নাথের জন্য একাধিক উৎসবের আয়োজন করা হয় গুন্ডিচা মন্দিরে। কথিত আছে, এই সাতদিন প্রভুর সঙ্গে দেবী লক্ষ্মী সরাসরি থাকেন না। তাই গুন্ডিচা মন্দিরে গোপীদের সঙ্গে লীলায় মত্ত হন জগন্নাথ। যার খেশারত অবশ্য শ্রীমন্দিরে ফেরার সময় দিতে হয় জগন্নাথকে। স্ত্রী লক্ষ্মীর মানভঞ্জন করতে রসোগোল্লা নিয়ে আসেন প্রভু জগন্নাথ। এমনই সব লোককথার ভিড়ে জগন্নাথ হয়ে উঠেছেন প্রাণের দেবতা। তাঁর অপার লীলায় মত্ত ভক্তকূল। এমনকি গুন্ডিচা মন্দিরের সঙ্গে শ্রীচৈতন্য দেবের মিলও খুঁজে পাওয়া যায়। শোনা যায়, রথের আগে নিয়ম করে গুন্ডিচা মন্দির পরিষ্কার করতেন চৈতন্য মহাপ্রভু। সেই রীতি বজায় রেখে, এখনও গৌড়ীয় মঠের সদস্যরা গুন্ডিচা মন্দির পরিস্কার করতে যান। সবমিলিয়ে গোটা পুরুষোত্তম ক্ষেত্র রথের এইকটা দিন রাজকীয় সাজে সেজে ওঠে। স্রেফ পুরীর অধিবাসীরা নয়, প্রভুর রথের মেতে ওঠেন দেশ বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত অগনিত ভক্তগণ।