লীলাবিলাসে তিনি গনধর্মের গনদেবতা। কখনও কালী, কখনও শিব আবার কখনও গণেশ রূপে তাঁর প্রকাশ। কথিত আছে, ভক্ত তাঁকে যে রূপে কল্পনা করবে, সেই রূপেই ধরা দেবেন প্রভু জগন্নাথ। তবে তাঁর উদ্ভবের নেপথ্যে বৌদ্ধ ঐতিহ্যের যোগও খুঁজে পান অনেক গবেষক। এর ঠিক কী ব্যাখ্যা দেয় শাস্ত্র? আসুন শুনে নিই।
দারুব্রহ্ম পুরুষোত্তম শ্রীজগন্নাথ, নীলাচলধামে অনাদিকাল থেকে তিনি লীলায় আলীন। তাঁর অমৃতময় চেতনায় বিশ্বের সমস্ত ধর্ম, দর্শন, তত্ত্ব ও মতের সমন্বয় ঘটেছে। তিনি কোনও নির্দিষ্ট জাতি বা ধর্মের দেবতা নন। তিনি সর্বধর্মের সংমিশ্রণে মানবধর্মের এক অভন্ন রূপ। তিনি সগুণের মূর্তিমন্ত প্রতীক, নির্গুণের নিরাকার অভিব্যক্তি, গাণপত্যের গণপতি, বৈষ্ণবের বিষ্ণু, শৈবের শিব, শাক্তর শক্তি জৈনের জিন এবং অবশ্যই বৌদ্ধের বুদ্ধ। প্রত্যেক ধর্মের সাধুসন্ত নিজের উপাস্য দেবতার সত্ত্বা ও স্বরূপ ওঁর ভিতর উপলব্ধি করেছেন।
আরও শুনুন: রথযাত্রায় জগন্নাথ যান গুণ্ডিচায়, সে সময় কি শূন্য থাকে শ্রীমন্দির?
শ্রীজগন্নাথ চেতনার বিকাশে বৌদ্ধ সংস্কৃতির ভূমিকা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ঐতিহাসিকরা বৌদ্ধমতের সঙ্গে জগন্নাথের একাধিক মিল খুঁজে পান। মনে করা হয়, বৌদ্ধ ধর্মের তিন মুখ্য প্রতীক তথা বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘ এঁদের থেকে জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রার উদ্ভব। আবার বৌদ্ধবিহারে সর্বপ্রধান পূজিত উপাদান হল ‘চক্র’। এর সঙ্গেও সুদর্শনের মিল রয়েছে বলে দাবি করেন ইতিহাসবিদরা। তাঁদের তথ্য অনুযায়ী, মৌর্য শাসক সম্রাট অশোক কলিঙ্গ বিজয়ের পর স্থানীয় এলাকায় বৌদ্ধ ধর্ম ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। সেভাবেই বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হন শবর সম্প্রদায়। সেখান থেকেই শবরদের ত্রিমূর্তি-তে বৌদ্ধ ধর্মের তিনটি প্রতীক মিশে যায়। এই ত্রিমূর্তিই আসলে জগন্নাথ-বলরাম ও সুভদ্রা। আবার কিছু গবেষকের মতে, শ্রীজগন্নাথের রথযাত্রা বুদ্ধদেবের জন্মোৎসবের অবসরে অনুষ্ঠিত রথযাত্রার রূপান্তরমাত্র। অন্যদিকে এমনও প্রচলিত রয়েছে, পুরী একসময় জনপ্রিয় বৌদ্ধ মঠ ছিল। সেসময় যার নাম ছিল দন্তপুরী। এই মঠের সঙ্গে ভগবান বুদ্ধের দাঁত সম্পর্কিত বিভিন্ন কিংবদন্তি প্রচলিত রয়েছে। এ প্রসঙ্গে আরও এক জোরালো প্রমাণ মেলে। বৌদ্ধ বজ্রযানেরপ্রধান শাসক রাজা ইন্দ্রভূতি তাঁর রাজত্বের সময় বুদ্ধ ও জগন্নাথকে একরূপেই কল্পনা করেছিলেন।
আরও শুনুন: রথযাত্রার আনন্দে মাতবে গোটা দেশ, কীভাবে সূচনা হয়েছিল এই উৎসবের?
তবে এইসব তথ্যকে ছাপিয়ে যায় জগন্নাথের কাষ্ঠবিগ্রহের অন্তরে অবস্থিত ব্রহ্মের সঙ্গে বুদ্ধযোগের প্রসঙ্গ। এই অনুমানের সমর্থন পাওয়া যায় বিভিন্ন ওড়িয়া পদকর্তার রচনায়। যার মধ্যে অবশ্যই উল্লেখ করতে হয়, ‘দারুব্রহ্মরুপে মুহি এঠারে বসিবি/ বৌদ্ধরূপে নীলাচলে লীলা প্রকাশিবি’। কিংবা শিশুদাম দাসের লেখা পদ,’ ঠাকুর বইলে রাজা হইল কি বাই/ কলিযুগে থিঁবু আহ্মে বৌদ্ধরূপ হই’। এর নেপথ্য কাহিনীটিও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। কথিত আছে, বুদ্ধদেবের মহাপরিনির্বাণেরপর পর তাঁর দেবাবশেষের একটি অংশ পেয়েছিলেন কলিঙ্গরাজ ব্রহ্মদত্ত। এইসময় ওড়িশায় বৌদ্ধদের প্রভাব বেশ কমে এসেছে। উল্টোদিকে হিন্দু প্রতিপত্তি বেশ জোরদার। তাই এমনটা মনে করা হয়, বুদ্ধের পূতাস্থির উপর নির্মিত স্তূপের ভেতর থেকে সেই অবশেষে বের করে বৌদ্ধ ত্রিশরনের আদলে জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রার ত্রিমূর্তি নির্মান করা হয়। আর এই মূর্তির ভিতর বুদ্ধের অস্তিস্থাপনা করা হয়। আধুনিক কালেও, নবকলেবর-এর সময় পুরনো মূর্তির ভেতর থেকে ব্রহ্ম বের করে নতুন দারুমূর্তিতে স্থাপন করা হয়। আর এই কাজ এতটাই সন্তর্পণে করা হয় যে, ওই ব্রহ্ম আসলে কী তার সদুত্ত্র এখনও কেউ দিতে পারেননি। এই প্রসঙ্গেই ব্রহ্মস্থানে বুদ্ধের অস্থি থাকার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দিতেন পারেন না কেউ।