বিষ্ণুর উপাসনায় পুজো করা হয় শালগ্রাম বা শালিগ্রাম শিলা। বৃক্ষপূজার রীতি আমাদের দেশে সুপ্রাচীন। শিবলিঙ্গের পূজার কথা তো আমরা জানিই। খানিকটা সেই পরম্পরাই যেন দেখা যায় শালগ্রাম শিলা পূজার ক্ষেত্রেও। তবে এর মধ্যে আবার মিশে আছে পৌরাণিক কাহিনিও। আসুন, শুনে নেওয়া যাক সে গল্প।
বিষ্ণুর উপাসনায় বা পূজায় শালগ্রাম শিলার ব্যবহার সেই আদি শঙ্করের কাল থেকেই হয়ে আসছে। পবিত্র এই শিলা দর্শনের উপদেশ দেওয়া হয় তীর্থযাত্রীদের বা পুণ্যার্থীদের। প্রকৃত শালগ্রাম শিলার দেখা পাওয়াও বেশ দুঃসাধ্য। নেপালের পশ্চিমে গণ্ডকি বা কালী-গণ্ডকি নদীতেই একমাত্র এই শিলার দর্শন মেলে। শালগ্রাম শিলা যেখানে পাওয়া যায় তা হরিক্ষেত্র বা মুক্তিনাথ নামে পরিচিত। মহামতী ভীষ্ম যখন তীর্থদর্শনে পেরিয়েছিলেন তখন তাঁকেও এই হরিক্ষেত্র দর্শনের কথা বলেছিলেন মহর্ষি পুল্যস্ত।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ১১): অন্য ভক্তদের সঙ্গে তর্ক করুক নরেন্দ্রনাথ, এ যেন ছিল ঠাকুরেরও ইচ্ছা
কিন্তু এই শালগ্রামকে কেন ঘরে ঘরে নারায়ণ জ্ঞানে পুজো করা হয়? সে সন্ধানে আমাদের ফিরতে হবে পৌরাণিক কাহিনির কাছে। সে কাহিনি শঙ্খচূড় নামে এক দানবের। তিনি পূর্বজন্মে ছিলেন কৃষ্ণসখা সুদামা। অভিশপ্ত হয়ে দানবের ঘরে জন্ম হয়েছিল বটে, কিন্তু তিনি বিষ্ণুভক্তই ছিলেন। এই শঙ্খচূড়ের নেতৃত্বে দানবরা দেবতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। কিছুতেই দেবতারা তাকে পরাস্ত করতে পারছিলেন না। শঙ্খচূড়ের বীরত্বের কাছে হার মানতে হচ্ছিল তাঁদের। আসরে অবতীর্ণ হলেন স্বয়ং মহাদেব। তিনি জানতে পারেন, শঙ্খচূড়ের শক্তি আসলে দুটো। এক, তাঁর বর্ম। আর দুই তাঁর সতীলক্ষ্মী স্ত্রী। এই দুইয়ের হরণ না হলে শঙ্খচূড়কে পরাস্ত করা সম্ভব নয়। এদিকে শঙ্খচূড়ের মৃত্যু নির্ধারিত হয়ে ছিল শিবের হাতেই। নইলে সুদামার শাপমোচন হবে না। আরও একটি ঘটনার সংযোগ ছিল এখানে। তুলসী দেবী একদা ভগবান বিষ্ণুকে স্বামী রূপে পাওয়ার জন্য তপস্যা করেছিলেন। সে সময় ব্রহ্মা তাকে জানিয়েছিলেন, বিষ্ণুকে তিনি স্বামী রূপে পাবেন না, তাঁর স্বামী হবেন শঙ্খচূড়। এই দুই ঘটনা মিলেমিশে এক হয়ে গেল। ভগবান বিষ্ণু এবার খানিক ছলনার আশ্রয় নিলেন। শঙ্খচূড়ের বর্ম চেয়ে নিলেন ভিক্ষাচ্ছলে। আবার তুলসী দেবীর সঙ্গও করলেন। এই দুইয়ের কারণে পরাস্ত হলেন শঙ্খচূড়, আসলে মুক্তি পেলেন সুদামা। আর তুলসীরও মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হল। কিন্তু তিনি তো স্বামী হিসাবে শঙ্খচূড়কেই বরণ করেছিলেন। তাই বিষ্ণুর ছলনায় ভারি ক্রুদ্ধ হলেন তুলসী দেবী। অভিশাপ দিলেন স্বয়ং বিষ্ণুকে। আবেগহীন হয়ে যে কাজ তিনি তাঁর সঙ্গে করেছেন, সেরকম আবেগহীন পাথর হয়েই থাকতে হবে। সেই অভিশাপেই বিষ্ণু পাথরের রূপ নেন। তাঁর দেহে বজ্রকীট নানা চিহ্ন বা চক্র এঁকে দেয়। এই চক্রচিহ্ন যুক্ত পাথরই আসলে শালগ্রাম শিলা। যেহেতু বিষ্ণুর সঙ্গে এই পাথরের সংযোগ রয়েছে পৌরাণিক উপাখ্যানে, তাই এই পাথরকে আজও নারায়ণ রূপে পূজা করা হয়। আর এই কারণেই শালগ্রামের পুজোইয় তুলসী নিবেদন করা হয়।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ১০): কেন নরেন্দ্রনাথকে অবাধ স্বাধীনতা দিতেন ঠাকুর?
আর একটা কথাও এখানে স্মরণ করতে হবে। আমাদের ধর্মবিশ্বাস বা আচার-বিচারের বেশ কিছু যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যাও তাই থাকে। শালগ্রাম পূজাও তাঁর ব্যতিক্রম নয়। যাঁরা জীবাশ্ম নিয়ে চর্চা করেন, তাঁরা বলেন এই শিলা আসলে এক বিরল প্রজাতির শামুকের জীবাশ্ম। বজ্রকীটের যে উল্লেখ পাওয়া যায় তা থেকে অনুমান হয়, বহু প্রাচীন কালের এক প্রজাতির নমুনা ধরা আছে এই শিলায়। আমাদের ঋষিরা শুধু অধ্যাত্ম চর্চাই করেননি, নানা শাস্ত্রে ছিল তাঁদের পারদর্শিতা। সেই হিসাবে, বিবর্তনের ব্যাখ্যায় এই শিলা বা জীবাশ্মর গুরুত্ব তাঁরা জানতেন, আর তাই একে এতখানি মর্যাদা দিয়েছিলেন। শালগ্রাম শিলার এরকম ব্যাখ্যাও করেন জ্ঞানীজনেরা।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ৯): নরেন্দ্রনাথের জন্য হাসিমুখে লাঞ্ছনাও ভোগ করেছিলেন ঠাকুর
তবে সবার উপরে জায়গা করে নিয়েছে বিশ্বাস এবং ভক্তি। মূলত পৌরাণিক কাহিনির সূত্র ধরেই হিন্দুদের পুজোপদ্ধতিতে বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে শালগ্রাম। হয়ে উঠেছে স্বয়ং নারায়ণেরই প্রতিরূপ।