চণ্ডীপাঠ ছাড়া দুর্গাপুজো সম্ভব নয়। শাস্ত্রেই এমন বিধান রয়েছে। তাই বাড়ির পুজো হোক বা মণ্ডপ, দেবী মূর্তির সামনে চণ্ডীপাঠ করতেই হয়। বলা হয়, সঠিক নিয়ম মেনে চণ্ডীপাঠ করলে বিশেষ উপকার মেলে। কিন্তু যে বাড়িতে দুর্গাপুজো হয় না, সেখানেও কী চণ্ডীপাঠ করা যায়? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
শাক্তধর্মের সর্বোচ্চ গ্রন্থ দেবীমাহাত্ম্যম্। যা দুর্গা সপ্তশতী বা চণ্ডী নামে পরিচিত। দেবী পার্বতী কীভাবে কাত্যায়নী রূপে মহিষাসুর বিনাশ করেছিলেন, সেই বিনাশ এবং বিজয়কাহিনী এখানে বর্ণিত। কথিত আছে, ঋষি মার্কণ্ডেয় এই গ্রন্থের প্রণেতা। এতেই লেখা রয়েছে, শারদীয়া দুর্গাপুজোয় ভক্তি সহকারে দেবীমাহাত্ম্য পাঠের কথা।
আরও শুনুন:
শুধু সিংহ নয়! দেবী চিত্তেশ্বরী দুর্গার পায়ের নিচে হাজির বাঘ, হত নরবলিও
শ্রীশ্রী চণ্ডীতে বলা হচ্ছে,
সর্বং মমৈতন্মাহাত্ম্যং মম সন্নিধিকারকম্। পশুপুষ্পার্ঘ্যধূপৈশ্চ গন্ধদীপৈস্তথোত্তমৈঃ।।
বিপ্রাণাং ভোজনৈর্হোমৈঃ প্রক্ষাণীয়ৈরহর্নিশম্। অন্যৈশ্চ বিবিধৈর্ভোগৈঃ প্রদানৈর্বৎসরেণ যা।।
প্রীতির্মে ক্ৰিয়তে সাস্মিন্ সকৃৎ সুচরিতে শ্রুতে। শ্রুতং হরতি পাপানি তথ্যারোগ্যং প্রযচ্ছতি।।
(ফলস্তুতির্নাম দ্বাদশোহধ্যায়ঃ)
অর্থাৎ, দেবী বলছেন – “আমার এই মাহাত্ম্যের সম্পূর্ণ পাঠ অথবা শ্রবণে আমার সান্নিধ্য লাভ হবে। পশু, পুষ্প, অর্ঘ্য, ধূপ, দীপ, গন্ধাদি উত্তম উপচারে পূজা করলে, ব্রাহ্মণ ভোজনাদি করালে, যাগযজ্ঞাদি ক্রিয়াকর্ম, নানাপ্রকার ভোজ্য অর্পণ এবং দান দ্বারা বছরভর আমার পূজা করলে আমি যতটা সন্তুষ্ট হই, এই মাহাত্ম্য একবার মাত্র শুনলে আমি সেই প্রীতি লাভ করি। এই মাহাত্ম্য শ্রবণে পাপনাশ এবং আরোগ্যপ্রাপ্তি হয়।”
আরও শুনুন:
দুরাচারী দৈত্যদের বধ করেছিলেন নারায়ণ, তবু দেবী দুর্গাই মধুকৈটভদলনী, কেন জানেন?
আসলে, দেবীমাহাত্ম্যম্ গ্রন্থের বিশিষ্টতাই হল এই গ্রন্থ পাঠের প্রথা। নবরাত্রি অথবা শারদীয়া দুর্গাপূজার সময়ে এই পাঠ আবশ্যক। এছাড়া বাংলার নানা ঘরোয়া কল্যাণকর অনুষ্ঠানে প্রথা রয়েছে চণ্ডীপাঠের। সাধারণ মানুষের কল্যাণ কামনায় হয় চণ্ডীযজ্ঞ। সেখানেও অবশ্য পালনীয় এক আচার, চণ্ডীপাঠ। সুতরাং দুর্গাপুজোর সময় বাড়িতে চণ্ডীপাঠ করলে যে সমস্যা কিছুই নেই, তা বলা যায়। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে ভক্তি আর নিষ্ঠায় যেন খামতি না থাকে। সাধারণ মানুষের চণ্ডীপাঠ নিয়ে রয়েছে নানা লোকবিশ্বাস। যেমন, ব্রাহ্মণ না হলে চণ্ডীপাঠ করতে নেই। চণ্ডীপাঠে উৎপন্ন হয় ক্ষাত্রতেজ। পাঠে ভ্রান্তি হলে পাঠক এবং গৃহস্থের অকল্যাণ হয় ইত্যাদি। তাই শাক্ত আরাধনার অন্যতম আকর এই গ্রন্থ পাঠ করতে অনেকেই ভয় পান। সমগ্র চণ্ডীই একটি মহামন্ত্র। সেক্ষেত্রে প্রতিটি শ্লোকের উচ্চারণ সঠিক হওয়া একান্ত প্রয়োজন। এছাড়া পাঠের সময় শুদ্ধচিত্তে থাকতে হয়। স্নান করে শুদ্ধ হয়ে বসতে হয় চণ্ডীপাঠে। সাধারণত দুর্গাপুজোর সপ্তমী থেকে নবমী অবধি চণ্ডীপাঠ করতে হয়। নিতান্তই অপারগ হলে মহানবমীতে পাঠ করতেই হবে শ্রীশ্রীচণ্ডী। তবে শাস্ত্রে যে নিয়ম, তা প্রতিপদ থেকে চণ্ডীপাঠের কথা বলে। অনেক বনেদী বাড়িতে এই নিয়ম মানা হয়। দেবীর কল্পারম্ভের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় চণ্ডীপাঠ। বাড়িতেও নিষ্ঠাভরে এমনটা করলে ক্ষতি নেই।
আসলে দেবীর কাছে রূপ, যশ, শত্রুনাশ, সৌভাগ্য সকলেই চেয়ে থাকেন। সবসময় সে প্রার্থনা শাস্ত্রীয় নিয়ম মেনে হয় না। শ্রীশ্রী চণ্ডীর পাঠ বা শ্রবণের প্রয়োজন এখানেই। দেবীর যে স্তব চণ্ডীতে উল্লেখ করা হয়েছে, তার সরল অর্থ করলে দাঁড়ায়, ‘হে দেবী আমাদের রূপ দাও, জয় দাও, যশ দাও, আমার শত্রুদের বিনাশ কর।’ মজার বিষয় এক্ষেত্রে দেবতা ও মানুষে কোনও ভেদ নেই। মহিষাসুরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে দেবতারাও দেবীকে এইভাবেই স্তবের মাধ্যমে জাগ্রত করেছিলেন। সেই কাজ মর্ত্যে কেউ করলে দেবী অতি প্রসন্না হন। কথিত আছে, মার্কণ্ডেয় পুরাণের ৮১-৯৩ অধ্যায়গুলি নিয়ে সম্পাদিত হয়েছিল দেবীমাহাত্ম্যম্ গ্রন্থটি। এই অংশের পাঠই প্রচলিত। সুতরাং ভক্তি এবং নিষ্ঠা সহকারে বাড়িতে চণ্ডীপাঠ করলে কোনও ভুল নেই, বরং তাতে গৃহস্থের কল্যাণ হয়।