দেবী দশপ্রহরণধারিনী। সনাতনী মূর্তিতে দেবী রণসাজে সজ্জিতা। দশ হাতে দশ রকমের অস্ত্র। কিন্তু কেন নির্দিষ্ট ভাবে দশ হাত দেখা যায় দেবী মূর্তিতে? একটাও বেশি নয়, কমও নয়! নেপথ্যে শাস্ত্রের কী ব্যাখ্যা? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
একটাও বেশি নয়, কমও নয়। গুনে গুনে দশখানা হাত দেবী দুর্গার। মহিষাসুরের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য দেবীকে দশ রকমের অস্ত্র দিয়েছিলেন দেবতারা। কিন্তু কেন? দশ হাতের নেপথ্যে শাস্ত্রের কী আদৌ কোনও ব্যাখ্যা রয়েছে?
আরও শুনুন:
দুর্গামূর্তিতে অসুরের গায়ের রং সবুজ, কেন এই নিয়ম জানেন?
অবশ্যই রয়েছে। তবে একটা নয়। একাধিক ব্যাখ্যা মেলে এর নেপথ্যে। সবথেকে প্রচলিত ব্যাখ্যাটি দশ দিকের কথা নির্দেশ করে। অর্থাৎ দেবীর দশ হাত আসলে দশ দিকের প্রতীক বলেই মনে করা হয়। দুরাচারী মহিষাসুর মায়াবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। যে কোনও মুহূর্তে যে কোনও দিকে প্রকট হতে পারতেন তিনি। দেবীকেও সবসময় সচেতন থাকতে হবে। তাই এই ব্যবস্থা। আবার কেউ বলেন এর সঙ্গে বর্ণের যোগ রয়েছে। গাত্রবর্ণ নয় অবশ্যই। এক্ষেত্রে বর্ণ বলতে সামাজিক ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। চারটি বর্ণের হিসাবে ২ টি করে হাত। সবমিলিয়ে ৮ টি। এর সঙ্গে নারীদের প্রতীক হিসেবে আরও দুটি হাত জুড়ে দশভুজা হয়েছিলেন দেবী। হিন্দু পুরাণে, মহিষাসুরকে যে ভয়ঙ্কর দুরাচারী রূপে দেখানো হয়েছে, সেই অসুর কাউকে রেয়াত করতেন না। বর্ণ জাতি নির্বিশেষে অত্যাচার চালাতেন। একইভাবে নারীকেও অবজ্ঞা করতেন মহিষাসুর। তাই সামগ্রিক ভাবে দেবীর দশ হাত সকলের হয়ে অত্যাচার দমন করেছে। তবে দশ হাতের কারণ হিসেবে দশ দিকের ব্যাখ্যাই অধিক জনপ্রিয়। এর সঙ্গে ত্রিদেব সহ বিভিন্ন দেবতার নাম জড়িয়ে। দশ অস্ত্রেরও রয়েছে বিশেষ গুণ।
আরও শুনুন: জবা কিংবা পদ্ম নয়, এই ফুল ছাড়াও দুর্গাপুজো অসম্ভব
প্রথমেই ত্রিশূল, যা দেবীকে দিয়েছিলেন স্বয়ং শূলপাণি শিব। ত্রিশূলের তিনটি ‘শূল’ ত্রিবস্তুর ইঙ্গিতবাহী। কখনও তা সত্ত্ব, রজ ও তম— এই ত্রিগুণের প্রতীক হিসেবে বর্ণিত। দেবীর হাতে যে সাপ দেখা যায়, সেটিও শিব-ই তাঁকে দিয়েছিলেন বলে মনে করা হয়। সাধনার ক্ষেত্রে সর্প হল কুলকুণ্ডলিনী শক্তির প্রতীক। সাধক মানসিক শক্তির চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছলে কুলকুণ্ডলিনীকে জাগরিত করতে পারেন বলে মনে করা হয়। বিষ্ণু দেন তাঁর হাতের সুদর্শন চক্র। শাস্ত্রমতে, সুদর্শন চক্রাকার ব্রহ্মাণ্ডের প্রতীক এবং দেবীশক্তি তার কেন্দ্রস্থল। দেবীকে যমরাজ দিয়েছিলেন কালদণ্ড বা গদা৷ যা মোহকে চূর্ণ করে। তিনিই দেবীকে খড়্গ প্রদান করেছিলেন বলেও জানায় পুরাণ। এই অস্ত্র মৃত্যুর ইঙ্গিতবাহী, আবার ন্যায়বিচারেরও প্রতীক। বিশ্বকর্মা দেবীকে দিয়েছিলেন কুঠার-সহ আরও বিভিন্ন অস্ত্র। যা কাধারে নির্মাণ ও ধ্বংসের প্রতীক। দুর্গাকে ধনুর্বাণ দান করেন পবন। গতির প্রতীক পবনদেবের অস্ত্রেও রয়েছে গতিশক্তিরই প্রকাশ। আবার অগ্নিদেব দুর্গার হাতে অগ্নি তুলে দিয়েছিলেন। সকল অশুভ, ক্লেদকে দহন করে শুদ্ধ করে সেই অগ্নি। জ্ঞানেরও প্রতীক অগ্নি। প্রকৃতি উপাসনার সঙ্গে যোগ রয়েছে দেবীর হাতের দেবরাজ ইন্দ্রের দেওয়া বজ্রর। জলদেবতা বরুণ দুর্গাকে প্রদান করেছিলেন শঙ্খ। যে কোনও মাঙ্গলিক কাজ থেকে শুরু করে যুদ্ধারম্ভ— সব কাজেই ব্যবহৃত হয়। আর ব্রহ্মার দেওয়া পদ্ম আধ্যাত্মিক জগতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক। মতান্তরে ব্রহ্মা নিজের কমণ্ডলু দান করেন দেবীকে। এই পাত্রে ধৃত জল সৃষ্টির প্রতীক। আসলে, দেবী দুর্গার হাতের অস্ত্রগুলি রূপক মাত্র। মনের অন্ধকার, অসংযমকে দূর করে এই দশ প্রহরণ। এগিয়ে দেয় আলোর উদ্দেশে, ভালর দিকে।