‘মায়ের পায়ে জবা হয়ে ওঠ না ফুটে মন…’। জবার মতোই, কালীপুজো যেন এই গান ছাড়া অচল। আবার বেশিরভাগ শ্যামাসঙ্গীতেই ঘুরে ফিরে জবা ফুলের উল্লেখ মেলে। তবে মা কালী কি শুধু জবা ফুলেই তুষ্ট হন? নাকি দেবী মূর্তিতে অন্য ফুলও দেওয়া চলে? আসুন শুনে নিই।
আর মাত্র কয়েকদিনের অপেক্ষা। অন্যরূপে উমা ফিরবেন মর্ত্যে। সেই মূর্তির প্রকাশ যতই উগ্র হোক, কারও কাছে তিনিও ঘরের মেয়ে। আবার কারও কাছে মাতৃস্বরূপা। দেবীর তন্ত্রোক্ত ভীষণদর্শণা মূর্তি বাদ দিলে, সাধারণত মন্ডপে মন্ডপে যে কালী মূর্তি চোখে পড়ে, তা মোটেও ভয়ঙ্কর নয়। কোথাও মূর্তি সজ্জায় অপরূপ ডাকের সাজ, কোথাও আবার দেবী শাড়ি পরিহিতা। তবে সব ক্ষেত্রেই যা থাকতে বাধ্য, তা হল মূর্তির পায়ে জবাফুল।
আরও শুনুন: রক্ষাকালী, শ্যামাকালী, দক্ষিণাকালী… কোন বৈশিষ্ট্যে বদলে যায় মা কালীর রূপ?
এমনিতে জবা বিভিন্ন রঙের হয়ে থাকে। তবে কালী পুজোয় মূলত রক্তজবা ব্যবহারের নিয়ম রয়েছে। এ ফুলের না আছে তেমন গন্ধ, না আছে বিশেষ কোনও বৈশিষ্ট্য। তবু দেবীর পায়ে ঠাঁই পেলেই জবা যেন হয়ে ওঠে অনন্য। বিখ্যাত সব কালীমন্দিরে প্রতিদিন হাজারও ভক্ত জবার মালা হাতে পুজো দিতে হাজির হয়। বেশিরভাগ মন্দিরে সেইসব মালা দেবী মূর্তিতে পরানোর চলও রয়েছে। তবে কালীপুজোর দিন ভিড় হয় চোখে পড়ার মতো। অনেকেই মনে করেন, বছরের একটা দিন মা কালীকে জবাফুল দিয়ে পুজো দিলে বিশেষ ফল মিলবে। একথা অস্বীকারের উপায়ও নেই। রক্তজবা সত্যিই দেবীর প্রিয়তম ফুল। এমনকি তন্ত্রসাধনাতেও মূলত এই ফুলই ব্যবহার করা হয়। তবে স্রেফ জবাফুলেই যে মা সন্তুষ্ট হন তা একেবারেই নয়। দেবী কালী আসলে শক্তিস্বরূপা। আদ্যাশক্তি মহামায়ার রূপ বিশেষ। তাই অন্যান্য দেবী মূর্তির মতো তাঁকেও পদ্ম নিবেদন করা যেতে পারে। বলা ভালো, বেশ কিছু কালীমন্দিরে জবার মতোই পদ্মফুল আবশ্যক। বিশেষত দেবীর প্রাণ প্রতিষ্ঠার সময় বা মূল পুষ্পার্ঘ্য নিবেদনের সময়ও পদ্মফুল দেওয়া হয়। এছাড়া নীল অপরাজিতা ফুলও দেওয়া যেতে পারে কালীমূর্তির পদতলে। মালা হিসেবে রজনীগন্ধা বা গাঁদা অত্যন্ত প্রচলিত। কাঞ্চন ফুলও দেবীর বিশেষ প্রিয়। তবে অন্যান্য সাদা ফুল দেবী পুজোয় ব্যবহার না করাই ভালো। তবে মাথায় রাখতে হবে, সাধারণ ভাবে আমরা যে কালীর পুজো করি, মূর্তিতে তিনি একা বিরাজ করেন না। দেবীর পদতলে স্বয়ং মহাদেবও বর্তমান। তাই কালীপুজোয় বেলপাতা রাখাও আবশ্যক। শিবের জন্য আকন্দ বা ধুতরো ফুলও রাখা যেতে পারে। এছাড়া হলুদ চাঁপা মহাদেবের বিশেষ প্রিয়। সেই হিসেবে কালী পুজোয় এই ফুলও ব্যবহার করা যেতে পারে।
আরও শুনুন: ‘আন্ডারওয়ার্ল্ড’ থেকে উত্থান মা কালীর! ভিনদেশির ‘বিকৃত’ ভাবনায় চটে লাল ভারতীয়রা
তবে অনেকের মনেই প্রশ্ন উঠতে পারে, জবা ফুল দেবী কালীর প্রিয় কেন?
এ প্রসঙ্গে বেশ কিছু প্রচলিত ব্যাখ্যা রয়েছে। প্রথমত শাস্ত্রে যে কালীপুজো পদ্ধতির উল্লেখ মেলে, সেখানে মূল উপকরণ হিসেবে রয়েছে এই জবা ফুল। যদিও যে কোনও শক্তিপুজোর ক্ষেত্রেই জবা ফুল ব্যবহারেরই নিয়ম রয়েছে। এমনকি দুর্গাপুজোয় সন্ধিপুজোর সময় জবাফুল থাকা আবশ্যক। কিন্তু দেবী কালীর সঙ্গে জবাফুলের নাম জড়িয়ে থাকার অন্যতম কারণ এই ফুলের গঠন। প্রচলিত ধারণা এই যে, জবা ফুলের পাপড়ি অনেকটা দেবী কালীর লোলজিহ্বার মতো। একইসঙ্গে এর রং টকটকে লাল। যা উগ্রতার প্রতীক বলেই মনে করেন অনেকে। সেই হিসেবেই দেবীর প্রিয় ফুল হিসেবে রক্তজবার জন্ম। বিখ্যাত চিত্রকরদের ছবিতেও কালিমূর্তির পদতলে জবাফুল দেখা যায়। এমনকি রামকৃষ্ণ, রামপ্রসাদ, বমাক্ষ্যাপার মতো সাধকরাও দেবীর পুজো করতেন মূলত জবাফুল দিয়েই। এই নিয়ে নানা কিংবদন্তিও রয়েছে। তবে স্রেফ জবাফুলেই দেবীর পুজো করতে হবে, শ্যামাকালীর ক্ষেত্রে অন্তত সেই নিয়ম খাটে। বরং অনেকেই আজকাল বিভিন্ন রংবেরঙের ফুলে মনের মতো করে মাতৃমূর্তি সাজিয়ে তোলেন। শাস্ত্রে এর তেমন উল্লেখ না মিললেও, ভক্তিভরে যে যেমনভাবে মায়ের পুজো করবে দেবী তাতেই সন্তুষ্ট হবেন।