কালী মাতৃস্বরূপা। কিন্তু শাস্ত্রমতে তিনি নগ্নিকা। তাই গানের মধ্যে ভক্তের আকুল আর্তি, ‘বসন পরো মা!’। প্রচলিত মূর্তিতে যদিও দেবী একেবারে দিগম্বরী নন। বিখ্যাত কয়েকটি মন্দিরেও তাঁকে শাড়ি পরানোর চল রয়েছে। কিন্তু শাস্ত্রে দেবী মূর্তিতে বসনের চিহ্নমাত্র নেই। কেন জানেন? আসুন শুনে নিই।
দেবী দুর্গার আরেক রূপ দেবী কালী। প্রচলিত ধারণা নয়, এই তত্ত্বের মান্যতা দেয় শাস্ত্রও। তবে দুর্গার সঙ্গে কালীর মিল বলতে স্রেফ দেবীত্বেই। না দুজনের গায়ের রঙে মিল, না হাতের সংখ্যায়। এমনকি দুর্গামূর্তি চণ্ডীস্বরূপা হয়েও শান্ত, এদিকে কালী ভয়ঙ্করী, লোলজিহ্বা। তবে একটা ক্ষেত্রে দুই মূর্তির পার্থক্য সবথেকে বেশি মাত্রায় লক্ষ করা যায়। তা হল দুই দেবীর অঙ্গসজ্জায়। দুর্গার আর যেসব রূপের পুজো হয়,যেমন জগদ্ধাত্রী, গন্ধেশ্বরী, বিপত্তারিণী- সব রূপেই দেবী বসন পরিহিতা এবং নানা অলংকারে ভূষিতা। ব্যতিক্রম কালী। শাস্ত্রমতে দেবীর এই রূপ, দিগম্বরী। অর্থাৎ দেবী সম্পূর্ণভাবে নগ্নিকা।
আরও শুনুন: দেবাদিদেব হয়েও কেন মা কালীর পদতলে থাকেন শিব?
যদিও এই নিয়ে তর্ক থাকতেই পারে। কারণ প্রচলিত মূর্তিতে দেবীকে শাড়ি পরিহিতা অবস্থাতেই দেখা যায়। তবে, শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যায় যে তাঁকে নগ্নিকা হিসাবেই বর্ণনা করা হয়েছে তা অস্বীকারের উপায় নেই। সেই নিরিখে, দেবী করালবদনী, মুক্তকেশী, চতুর্ভুজা এবং মুণ্ডমালাবিভূষিতা। শুধু তাই নয়, দেবীর কোমরবন্ধনী হল অর্ধেক কাটা হাতের তৈরি মেখলা। দেবীর কানের দুলও দুটি শব। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এমনটা হওয়ার কারণ কী?
শাস্ত্রে এর সব ব্যাখ্যাই মেলে। প্রথমে আসা যাক দেবীর নগ্ন রূপের প্রসঙ্গে। এক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে, কালী মানে যেমন দেবী দুর্গার রূপ, তেমনই তিনি কালের অধিষ্ঠাত্রী। দশ মহাবিদ্যার অন্যতমা এই দেবীকেই কালের নিয়ন্ত্রক হিসেবে অর্চনা করেন শাস্ত্রজ্ঞরা। বলা হয়, দেবী কালীই আদিশক্তি। তাই তিনি কাল বা সময়ের থেকেও উঁচু স্তরে বিরাজ করছেন। কালের সীমানায় তাঁকে আটকে রাখা অসম্ভব। তিনি অনন্ত। তাঁর মধ্যেই বিলীন হয়েছে সৃষ্টি। কালীতেই শুরু। কালীতেই শেষ। সেই হিসেবে কোনও জাগতিক বস্ত্রের আবরণে তাঁকে আবৃত করা যায় না। আবার কালী প্রতিনিয়ত ব্রহ্মাণ্ড প্রসব করছেন, এই উল্লেখও শাস্ত্রে মেলে। সেই সূত্র ধরে বলা যায়, প্রসবের সময় মায়ের শরীরে বস্ত্রের আচ্ছাদন যেমন অপ্রাসঙ্গিক, তেমনই দেবী কালীকেও কোনও জাগতিক বস্ত্র ঢেকে রাখতে পারে না। রইল পড়ে লজ্জার প্রসঙ্গ! সেক্ষেত্রে সহজেই বলা যায়, যাঁর থেকে ভব সংসারের সৃষ্টি তাঁর লজ্জায় কারণ কী-ই বা হতে পারে। তাই দেবী নগ্নিকা। আবার কোনও কোনও মতে বলা হয়ে থাকে, কালী হলেন শক্তির প্রতীক। শক্তি মাত্রেই অসীম। তার না আছে সৃষ্টি আ আছে বিনাশ। বিজ্ঞানের প্রসঙ্গ টেনে বলতে গেলে, শক্তিকে কেবল অনুভব করা যায়। তাহলে শক্তিস্বরূপা কালীকে কোন বসন আবদ্ধ করবে? সেই হিসেবে নগ্নিকা রূপেই কালীর ধারণা গড়ে উঠেছে।
আরও শুনুন: রক্তজবা ছাড়া হয় না কালীপুজো, দেবীর পায়ে আর কোন কোন ফুল দেওয়া যায়?
আবার কেউ কেউ বলে থাকেন, দিগম্বরী শব্দটির মধ্যেই যাবতীয় রহস্য লুকিয়ে। এক অর্থে তা নগ্নিকা। আবার অম্বর যদি পোশাক অর্থে ধরা যায়, তাহলে বোঝা যায়, এই বসনের কোনও অন্ত নেই। দিক বলতে সাধারণ কল্পনা যতদূর প্রসারিত হত, এই বসনপ্রান্ত তারও থেকে বেশি দূরে প্রসারিত। সেই অর্থে কালীর পরনে যে বসন তা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় না বলে তাঁকে নগ্নিকা বলে ভেবে নেওয়ার চল রয়েছে।
এবার অনেকেই বলতে পারেন, বিভিন্ন সাধক কালীকে বস্ত্র পরিহিতা অবস্থাতেই কল্পনা করেছেন কেন?
আসলে সাধনার উচ্চস্তরে পৌঁছে গেলে স্রেফ তন্ত্র বা মন্ত্রের আচ্ছাদনে দেবী বদ্ধ থাকেন না। একইসঙ্গে সাধকও যাবতীয় নিয়মের ঊর্ধ্বে চলে যান। যা আপাতভাবে অনেকের কাছেই অন্যরকম ঠেকতে পারে। যেমন, শ্রীরামকৃষ্ণ, বামাক্ষ্যাপা বা রামপ্রসাদের কাছে কালী কোনও তান্ত্রিক দেবী ছিলেন না। তিনি হয়ে উঠেছিলেন কারও মা আবার কারও মেয়ে। তাই ঠিক যেভাবে একজন সন্তান তার ‘মা’ কে, কিংবা একজন পিতা তাঁর মেয়েকে কল্পনা করেন, কালীকেও এঁরা সেই রূপেই দেখেছেন। বলা বাহুল্য, দেবীও সেই রূপেই তাঁদের কাছে ধরা দিয়েছেন। ভক্তির সামনে ব্যর্থ হয়েছে যাবতীয় তত্ত্ব বা যুক্তি। তবে ধ্যানমূর্তি মেনে দেবীর যে মূর্তি কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ তৈরি করেছিলেন সেখানে দেবী নগ্নিকা। এখনও নবদ্বীপে যে আগমকালীর পুজো হয়, সেই মূর্তি পুরনো ধাঁচেই তৈরি।