দনুজদলনী দুর্গা। দেবী দশভুজা। দশ হাতে দশ রণ প্রহরণ। তার মধ্যে প্রধান অস্ত্র ত্রিশূল, দিয়ে তিনি বধ করছেন মহিষাসুরকে। সনাতনী দুর্গামূর্তিতে মহিষাসুরের স্থান দেবীর পদতলে। তবে তার গায়ের রং গাঢ় সবুজ। কেন এমন রং? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
বছরঘুরে মর্তে ফিরবেন উমা। সূচনা হবে দেবীপক্ষের। মহালয়ার ভোরের সুর জানান দেবে দেবীর আগমনী বার্তার। রেডিও, টেলিভিশনে এইদিন মহিষাসুর বধের অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয়। কীভাবে দুরাচারী অসুররাজকে বধ করলেন দেবী, সেই কাহিনি বিস্তারে বর্ণনা করা হয়। কিন্তু সম্প্রচারিত অংশে মহিষাসুরকে যে রুপে দেখানো হয়, মণ্ডপের অসুর মোটেও তেমন নন। অন্তত গায়ের রঙের বিচারে। অধিকাংশ মণ্ডপেই দেবীর পদতলে যে অসুরকে দেখা যায়, তার গায়ের রং গাঢ় সবুজ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এর নেপথ্যে কারণ কী?
শাক্তধর্মের সর্বোচ্চ গ্রন্থ দেবীমাহাত্ম্যম্। এই গ্রন্থ দুর্গা সপ্তশতী বা চণ্ডী নামেও পরিচিত। দেবী পার্বতী কীভাবে কাত্যায়নী রূপে মহিষাসুর বিনাশ করেছিলেন, সেই বিনাশ এবং বিজয়কাহিনী এখানে বর্ণিত। ঋষি মার্কণ্ডেয় এই গ্রন্থের প্রণেতা। সেখানেই দেবীর রূপকল্পের বর্ণনা মেলে। শাস্ত্রে দেবীকে তপ্তকাঞ্চনবর্ণা হিসেবেও উল্লেখ করা হয়েছে। সেই হিসাবে দেবীর গায়ের রং হলুদ করা হয়। অন্তত সনাতনী মূর্তিতে। তবে মহিষাসুর আসলে কেমন, সেই রূপের ব্যাখ্যা সর্বত্র মেলে না। প্রচলিত রীতি এবং পুরাণের কিছু কাহিনি মেনে মহিষাসুরের মূর্তি তৈরি করা হয়। আর সেখানেই মহিষাসুর গাঢ় সবুজ বর্ণের। এক্ষেত্রে বলতে হয় মহিষাসুরের জন্মবৃত্তান্তের কথা। সেই সূত্র ধরেই মহিষাসুরের সবুজ গাত্রবর্ণের ইঙ্গিত মিলতে পারে।
পুরাণমতে, মহিষী এবং রম্ভের পুত্র এই মহিষাসুর। পিতা রম্ভ বর পেয়েছিলেন পুত্র হবে প্রবল প্রতাপশালী। বাস্তবে হয়েওছিল তাই। এরপর দৈত্যগুরুর আশীর্বাদ নিয়ে মহিষাসুর বিশেষ এক বরও পেয়েছিলেন। কোনও পুরুষ তাঁকে হত্যা করতে পারবে না। এই বলের জোরেই স্বর্গ আক্রমণে উদ্যত হন অসুররাজ। তাঁর অত্যাচারে ত্রিলোকে ত্রাহি ত্রাহি রব পরে যায়। এরপর দেবতাদের পুঞ্জীভূত তেজ থেকে জন্ম নেন দেবী দুর্গা। আদিশক্তি মহামায়ার হাতেই শূলবিদ্ধ হন মহিষাসুর। তবে এমনটা সহজে হয়নি। হয়েছিল এক ভয়ানক যুদ্ধ। সেখানে নানা রূপে ছলনার চেষ্টা করে মহিষাসুর। জন্মসূত্রেই সেই ক্ষমতা তাঁর ছিল। বারবার নিজেকে মহিষের পেটে লুকিয়ে রাখতে পারতেন। গজ রূপেও দেবীকে আক্রমণের চেষ্টা করেন। তবে যে মুহূর্তে দেবী তাঁকে বধ করছেন, তখন মহিষাসুরের অর্ধেক শরীর মহিষের পেটে। আর সেই অংশের রং গাঢ় সবুজ। সেই মতোই তৈরি হয় দেবী মূর্তিতে থাকা প্রচলিত মহিষাসুর। আবার এমনটাও বলা হয়, যেহেতু অসুর আর্যশ্রেণীর কেউ নন। সুতরাং তার গায়ের রং ফরসা নয়। গাত্রবর্ণ কালো, বাদামী বা গাঢ় সবুজ। বর্তমানে থিম পুজোর চল সর্বত্র। সেই হিসাবে মহিষাসুরের রঙও বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। তবে প্রচলিত সনাতনী মূর্তিতে মহিষাসুরের রং সবুজই রাখা হয়। কেউ বলেন এটাই শাস্ত্রের নিয়ম। কেউ আবার বলেন এটা প্রচলিত ধারণা। যেহেতু দেবী রূপকল্পের মতো অসুরের গাত্রবর্ণের উল্লেখ সব জায়গায় মেলে না, তাই এই নিয়মেই অসুরের মূর্তি তৈরি হয়ে আসছে।