দুর্গাপুজো বাঙালির প্রধান উৎসব। কিন্তু তাই বলে দেশের আর কোথাও দেবীর আরাধনা হয় না, এমনটা একেবারেই নয়। শুধু হয় বললে ভুল হবে, আরও বড় আকারে দেবীর পুজোর ব্যবস্থা করা হয় বাং;আর বাইরের কিছু মন্দিরে। কোন কোন রাজ্যের দুর্গামন্দির রয়েছে তালিকায়? শুনে নিন।
বাংলায় যখন ‘দুর্গাপুজো’, গোটা উত্তরভারত জুড়ে তখন ‘নবরাত্রি’। আপাতভাবে শব্দদুটো আলাদা শোনালেও, আরাধনা কেন্দ্রে একজন দেবীই রয়েছেন। সেই আদিশক্তি পরমাপ্রকৃতি মহামায়া। তাঁর নয় বিশেষ রূপের আরাধনায় পালিত হয় নবরাত্রি, আর মহিষমর্দিনী রূপের আরাধনায় শারদীয়া দুর্গোৎসব। তবে সেই পুজোতেও অবশ্যই উচ্চারিত হয় নবদুর্গার ধ্যানমন্ত্র। এই সূত্র ধরাই আলোচনা করা যেতে পারে বাংলার বাইরেই দেবী দুর্গার বিভিন্ন রূপ সম্পর্কে। এর উল্লেখ রয়েছে শাস্ত্রেও।
কালিকাপুরানে আমরা দেখি,
ওড়দেশে কলিঙ্গে চ মধ্যদেশে তথৈব চ | দেবীচাষ্টভূজা পূজ্যা অযোধ্যায়াং সুরাষ্ট্রকে || বিহারে চৈব শ্রীহট্টে কোশলে শরবল্লকে | অষ্টাদশভূজা পূজ্যা মহেন্দ্রে চ হিমালয়ে || কৌরবে মথুরায়াঞ্চ কেদারে রামঠেহপি চ | পূজয়েদ্দাদশভূজাং মকরন্দে বিরাটকে || কৌমারে চৈব গৌড়ে চ পরিযাত্রে চ দক্ষিণে | দেবী দশভূজা কার্য্যা মরহট্টে গজাহ্বয়ে || পূর্ণে চৈব তু নেপালে কচ্ছদেশে চ কঙ্কণে | চতুর্ভূজা ভবেদ্দেবী দ্বিভূজা সাগরান্তিকে ||
এই অংশে দেবীর বিশেষ কিছু রূপের বর্ণনা আমরা পাই। কোথায় দেবীর বিগ্রহ কেমন হবে, মূর্তিতে কতগুলি ভুজ বা হাত থাকবে, সেইসব কিছু এখানে ব্যাখ্যা করছেন দেবাদিদেব মহেশ্বর। সেই হিসেবে, দেবীর অষ্টভূজা মূর্তি থাকার কথা, ওড়দেশ বা ওড়িশা, কলিঙ্গ তথা পুরী, মধ্যদেশ, অযোধ্যা এবং সৌরাষ্ট্র বা গুজরাটে। এরপর উল্লেখ রয়েছে দেবীর অষ্টদশভূজা মূর্তির কথা। সেক্ষেত্রে দেবীর মন্দির থাকবে, বিহার, শ্রীহট্ট, কোশলে, মহেন্দ্রে এবং হিমালয়। এছাড়া মথুরা, কেদার, রামেশ্বর, মকরন্দ ও বিরাট বা লখনউ অঞ্চলে দেবীর দ্বাদশভূজা বিগ্রহ পূজা হবে | কন্যাকুমারী, গৌড়বঙ্গে বা বাংলা, দক্ষিণ ভারত, মরহট্টে পূজিতা হবেন দেবী দশভূজা রূপে। এরপর দেবীর চতুর্ভুজা মূর্তি। এই শ্লোক অনুযায়ী দেবীর তেমন মূর্তির দেখা যায় নেপালে, কচ্ছদেশে ও কঙ্কণ বা গোয়ায়। অন্যদিকে দেবীর দ্বিভূজা মূর্তির মন্দির থাকার কথা সাগরন্তাকিকে বা গঙ্গাসাগরে।
আরও শুনুন: Durga Puja 2023: গয়না পরেই ভাসান দেবীর, দুর্গাপুজো হত জোড়াসাঁকোর ব্রাহ্ম ঠাকুরবাড়িতেও
এতো গেল শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা। এবার জেনে নেওয়া যাক সত্যিই এইসব অঞ্চলে দেবীর কেমন মন্দির রয়েছে। একথা বলাই বাহুল্য, দেবী দুর্গার মন্দির রয়েছে দেশের সর্বত্রই। বেশিরভাগ মন্দিরে সারাবছর নিত্যপুজোর চল রয়েছে। তবে দেবীপক্ষে অর্থাৎ মহালয়ার পর থেকে মন্দিরগুলিতে শুরু হয় নবরাত্রির পুজো। আর দুর্গাপুজোর চারদিন তো অবশ্যই বিশেষ পুজো হয়। প্রথমে উত্তরভারত থেকেই শুরু করা যাক। দেশের নানা প্রান্তে যে সতীপীঠ রয়েছে তার বেশ কয়েকটি রয়েছে উত্তরভারতে। প্রথমেই বলতে হয় কুরুক্ষেত্রের কাছে অবস্থিত সতীপীঠটির কথা। এখানে দেবীর দক্ষিণ গুলফ পড়েছিল। এছাড়া হরিয়ানার রোটকে রয়েছে এক প্রাচীন দুর্গা মন্দির। এখানে দিনরাত ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালানোর নিয়ম রয়েছে। একইসঙ্গে বলতে হয় বিন্ধ্যবাসিনী দেবীর কথাও। এখানে পাথরে খোদিত অষ্টভূজা মূর্তি দেখা যায়। এছাড়া বৃন্দাবন, বেনারস, উত্তরাখণ্ড সহ একাধিক জায়গায় দেবী দুর্গার বেশকিছু জনপ্রিয় মন্দির রয়েছে। মধ্যভারতেও দেবীর মন্দিরের সংখ্যা নেহাতই কম নয়। এখানে এমন কিছু মন্দিরও রয়েছে, যেখানে দেবী অষ্টদশভূজা। তারমধ্যে ওড়িশার নিশ্চিন্তকোউলি অঞ্চলের এক মন্দিরে দেবীর মূর্তিতে কুড়িটি হাত দেখা যায়। থিমের দৌলতে আজকাল এইধরনের মূর্তি দেখা গেলেও ওড়িশার এই মন্দির প্রাচীন এবং প্রসিদ্ধ। মধ্যপ্রদেশের জব্বলপুরের কাছে রয়েছে গৌরীশঙ্করের এক মন্দির। তবে দক্ষিণ ভারতের অনেকাংশে দেবী দুর্গার লৌকিক রূপে দেখা যায়। কোথাও তিনি গ্রাম্যদেবতা। সেখানে মহিষাসুরকে বধ করে তিনি সমাজকে রক্ষা করেছেন। এক্ষেত্রে কনক দুর্গা আম্মনের কথা বলা যায়। এছাড়া মেঘালয়, জয়ন্তীয়া অঞ্চলেও দুর্গা মন্দির রয়েছে। যেখানে শাস্ত্রমতে নির্মিত প্রাচীন প্রস্তরমূর্তি দেখা যায়। তবে দেবীর বিশেষ এক মন্দির রয়েছে ত্রিপুরায়। মন্দিরটি সেখানকার রাজ পরিবারের। দীর্ঘদিন ধরে সেখানে দেবী দ্বিভূজা রূপে পূজিতা হয়ে আসছেন। এছাড়া ত্রিপুরায় আরও বেশ কয়েকটি দুর্গামন্দির রয়েছে। পাশাপাশি বাংলার মতোই এখানে দুর্গোৎসব পালিত হয়ে মহাসমারোহে। দুর্গাপুজোয় একই পরিবেশ দেখা যায় মুম্বইয়েও। একইসঙ্গে ঝাড়খণ্ডের এক দুর্গামন্দিরে এখনও পুজোর প্রতিদিন পাঁঠা বলির চল রয়েছে। তবে কোথাও-ই দেবীর একটা মাত্র রূপের আরাধনা হয় না। শাস্ত্রে যেমনটা উল্লিখিত, তেমনই দেবীর অষ্টভুজা, দ্বিভূজা, চতুর্ভূজা মূর্তি দেখা যায় এইসব মন্দিরে। তবে মূর্তি বিশেষত্ব যতই আলাদা হোক, পুজোর রীতিতে তেমন বদলায় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তন্ত্রোক্তমতে দেবীর পুজো করা হয়। আর দুর্গাপুজোর সময় সপ্তমী অষ্টমী নবমী দশমী তিথি পালনের নিয়মই প্রায় সর্বত্রই এক। সুতরাং একথা বলাই বাহুল্য, প্রতিবছর দেবী মহামায়ার আরাধনায় বিশেষ উদযাপনে সামিল হন দেশবাসী। এবং দেবীর আহবানে বারবার একসূত্রে বাধা পড়ে গোটা ভারতবর্ষ।