শ্রীরামকৃষ্ণদেব তাঁকে দেবীজ্ঞানে পুজো করেছিলেন। তিনি জগতজননী। শুধুমাত্র ভক্তবৃন্দের নয়। দেবী সারদা সকলের ‘মা’। অন্যের কষ্ট দেখলে বরাবরই তার প্রাণ কাঁদে। একসময় তিনি নিজে হাতে পাতা ধুয়ে, কাপড় দিয়ে মুছে তবে সকলকে প্রসাদ দিতেন। রামকৃষ্ণের স্মরণে গৃহত্যাগী সন্ন্যাসীদের কাছে তিনিই ছিলেন পরমারাধ্যা। তিনি উদ্যোগ না নিলে প্রতিষ্ঠা হত না রামকৃষ্ণ সংঘ। তাই তিনিই সংঘজননী। আসুন আমরা আজ শুনে নিই শ্রী শ্রী মায়ের উদ্যোগে সংঘ প্রতিষ্ঠার কথা।
ঠাকুর বুঝিয়ে দেন, যিনি রাম, যিনি কৃষ্ণ, তিনিই এসেছিলেন এ যুগে রামকৃষ্ণ হয়ে। ঠাকুরের সেই অপরূপ লীলার সাক্ষী গোটা বিশ্ব। এদিকে ঠাকুরের লীলার পাশে পাশেই তো বয়ে চলেছে আর এক লীলামাধুরীর অপূর্ব স্রোত। সে লীলা শ্রীশ্রী মায়ের। তিনিও তো কোনও কিছুই প্রকাশ করেন না। আড়াল করে রাখেন নিজেকে।
আরও শুনুন: দুষ্ট লোক অনিষ্ট করতে চাইলে ধার্মিক মানুষের কী করণীয়?
১৮৮৬ সালে ঠাকুর ইহলোক ত্যাগ করলেন। বিবেকানন্দ সহ অনেকেই তখন তাঁর স্মরণে গৃহত্যাগী হয়েছেন। তাঁদের একমাত্র আরাধ্যা মা সারদা। যাবতীই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর কাছেই আশ্রয় নেন ভক্তরা। তাঁরা গৃহত্যাগী হলেও নির্দিষ্ট কোনও থাকার জায়গা সেইসময় তাঁদের ছিল না। নিজেদের মতো বিভিন্ন তীর্থে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তিনি। ঠাকুরের চলে যাওয়ার পর এভাবেই কেটে গেল চার চারটে বছর। ১৮৯০ সালে তিনি বুদ্ধগয়া ভ্রমণে গেলেন। দেখলেন সেখানকার মঠ এবং সেই মঠের সাধুদের সংঘবদ্ধ জীবনযাপন। মনে পড়ল তাঁর ছেলেদের কথা। গৃহত্যাগী সন্ন্যাসীদের কথা। তাঁরা তো এমনভাবে নেই। তাঁদের কষ্টের কথা মনে পড়ে ব্যথিত হলেন শ্রীমা। তাঁদের নির্দিষ্ট কোনও আশ্রয় নেই। দুটি অন্নের স্থায়ী সংস্থান নেই। মনে মনে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করলেন, ছেলেদের জন্যেও যেন অনুরূপ ব্যবস্থা হয়। সেই শুরু। মায়ের কথায়, এর জন্য ঠাকুরের কাছে কতই না কেঁদেছেন তিনি। সেই প্রার্থনায় বারবার ফুটে উঠত খানিকটা এই ধরনের কথা। খানিক অভিযোগের সুরেই তিনি বলতেন, ঠাকুর এলেন আর দুদিনের জন্য আনন্দ করে লীলা করে চলে গেলেন- তা হবে না। ঠাকুরের নাম নিয়ে যারা ঘর ছাড়ল, তাঁরা কি পথে পথে ভিক্ষে করে খাবে! মা হয়ে সন্তানের এই দশা তিনি দেখতে পারবেন না। ঠাকুরের কাছে তাই তাঁর প্রার্থনা, ভক্তদের যেন মোটা ভাত কাপড়ের অভাব না হয়। তারা যেন ঠাকুরের নাম নিয়ে, ভাব-উপদেশ নিয়ে একত্রে এক জায়গায় থাকতে পারে। এই ভাবনাই তো পরবর্তীকালে জন্ম দিয়েছে রামকৃষ্ণ সংঘের। তাই তো তিনি সংঘজননী। একাধারে তাই তিনি লক্ষ্মী এবং সরস্বতী। অপ্রকাশের লীলায় নিজেকে প্রকাশ করেননি কখনও। তবু তাঁর পায়ের ছাপ যেন আলপনা হয়ে আঁকা আছে সর্বত্রই।
আরও শুনুন: ঈশ্বরকে মানুষ আর মানুষকে ঈশ্বরের মতো করে দেখার শিক্ষা শ্রীরামকৃষ্ণের
এখানেই শেষ নয়। ভক্ত মাত্রেই তাঁর কাছে সন্তানসম। তাঁরা ভুল করলেও তিনি মা। ঠিক করলেও তিনি মা। সকলকে এক নজরে দেখতেন। আর এই যেন মনে করিয়ে দেয় আরও এক প্রসঙ্গ। রামকৃষ্ণ ধারার যে আন্দোলন, তা ব্যক্তিগত সিদ্ধির উপর জোর না দিয়ে প্রসারিত হয়েছে লোকহিতে। অধ্যাত্মসাধন আর গণমানুষের মঙ্গলকামনা পাশাপাশি এসেছে। মা সারদার হাত ধরে তা আরও স্পষ্ট হয়েছে। ঠাকুরের যে উপদেশ, তা ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োগ করে তপস্যাকে আধুনিক করলেন সারদা। এই সহনশীলতা, সেবা, তিতিক্ষা- আমাদের আজও জরুরি, নানা প্রেক্ষিতেই। জীবনের ছোট ছোট ঘটনায় সেই শিক্ষা দিয়ে গিয়েছিলেন সারদা। রামকৃষ্ণ ধারার লোকসেবার ভাবনা, সারদা ছাড়া এমন সুসংহত রূপ পেত না।