কালো নয়। জগন্নাথের রং নীল। একেবারে ঘরের ছেলের মতোই তাঁকে অর্চনা করা হয়। তাই পুজোর দায়িত্ব সামলান মহিলারাই। সামান্য ফ্যান ভাত আর ডাল সেদ্ধ ভোগেই তিনি তুষ্ট। বাংলার একেবারে নিজস্ব জগন্নাথ এই নীলবর্ণের মাধব। কোথায় রয়েছে প্রভুর এই মন্দির? জানালেন শুভদীপ রায়।
মহিলারা নারায়ণ স্পর্শ করতে পারবেন না, এমনটাই প্রচলিত নিয়ম। কিন্তু এই ধারণার ব্যতিক্রম কেষ্টপুরের নীল জগন্নাথ। তাঁর পূজায় বাড়ির মহিলাদের অবাধ বিচরণ। ভক্তের ভগবান এখানে গোপাল রূপে ধরা দেন। সামান্য আয়োজনেই তিনি তুষ্ট। কিন্তু তাঁর এমন অদ্ভুত রূপের নেপথ্যে কারণ কী? সে প্রসঙ্গে বিস্তারিত জানালেন নীল জগন্নাথ মহাপ্রভুর অন্যতম সেবায়েত অঙ্কিত দেবনাথ। শুনে নেওয়া যাক সে কথাই।
আরও শুনুন: স্বয়ং কৃষ্ণের লীলার সঙ্গে যোগ, প্রভু জগন্নাথকে কেন ৫৬ ভোগ দেওয়া হয় জানেন?
কেষ্টপুরের ক্রিশ্চানপাড়ায় প্রভুর মন্দির। ঠিক মন্দির বললে ভুল হবে, দেবনাথ পরিবারের আরাধ্য নীল জগন্নাথ বাড়িতেই নিত্যপূজিত হন। যদিও প্রথম থেকেই তাঁদের বাড়িতে জগন্নাথের রূপ নীল ছিল না। মোটামুটি ২০০৩ সাল থেকে পুজো করছেন তাঁরা, সেখানে সাধারণ কৃষ্ণ বর্ণের জগন্নাথই পূজিত হতেন। তবে সেই মূর্তি ছিল মাটির। নিজেদের সামর্থ্যমতো জগন্নাথের সেবা করতেন তাঁরা। আয়োজন করতেন রথেরও। পরিবারের সকলেই জগন্নাথ ভক্ত, তাই রথের দিন স্থানীয় এক জগন্নাথ মন্দিরের রথেও অংশ নিতেন তাঁরা। কিন্তু সেই মন্দিরের নিয়ম ছিল, মহিলারা জগন্নাথ স্পর্শ করতে পারবেন না। যদিও এই নিয়ম দেশের অনেক নারায়ণ মন্দিরেই দেখা যায়। অনেক শাস্ত্রজ্ঞই বিধান দেন, নারায়ণ শিলা মহিলাদের স্পর্শের অধিকার নেই। এদিকে দেবনাথ পরিবারের মহিলারা জগন্নাথকে স্পর্শ করতে না পেরে ব্যাকুল হয়ে উঠতেন। যেখানে বাড়ির গোপালকে মহিলাদের পুজো করতে সমস্যা নেই, সেখানে তাঁরই অন্যরূপ ছুঁতে পারবেন না মেয়েরা! এই নিয়ম তাঁদের মন মানতে পারত না। তাই ঠিক করেন, বাড়ির জগন্নাথের রথই বড় করে আয়োজন করবেন। সেক্ষেত্রে তাঁকে বাড়ির ছেলের মতোই মহিলারা অর্চনা করতেন।
আরও শুনুন: শ্রীমন্দিরে অপূর্ব লীলা, জগন্নাথের সঙ্গে কেন থাকেন দেবী বিমলা?
তখনও দেবনাথ বাড়ির জগন্নাথ ছিলেন কৃষ্ণবর্ণেরই। রূপ পরিবর্তনের ঘটনাটি ঘটে বছর চারেক আগে। সেই বছর রথের আগে জগন্নাথের মৃন্ময়ী মূর্তি অসাবধানতার জেরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে ভারি চিন্তায় পড়ে যান পরিবারের সকলেই। বিভিন্ন পণ্ডিতের সঙ্গে কথা বলে তাঁরা ঠিক করেন প্রভুর দারুমূর্তি স্থাপন করবেন। সেইমতো নবদ্বীপে শুরু হয় জগন্নাথের দারুরূপের নির্মাণ। সব কিছু ঠিকমতোই এগোচ্ছিল। এমন সময় অঙ্কিতবাবুর মা তথা পরিবারের কর্ত্রী নূপুর দেবী স্বপ্ন দেখেন, এক নীল বর্ণের বালক তাঁর কোলে খেলা করছে। একদিকে জগন্নাথ মূর্তি তৈরি হচ্ছে। সেই সময় এমন স্বপ্ন নেহাতই কাকতালীয় নয় বলেই মনে করেছিলেন দেবনাথ বাড়ির সকলে। তাঁদের ইচ্ছায় সেই নীল বর্ণের বালকের মতোই রূপ দেওয়া হয় জগন্নাথের। কিছুদিনের মধ্যেই শেষ হয় নীল জগন্নাথের নির্মাণকাজ। শুধু জগন্নাথ নন, বলরাম ও সুভদ্রা মূর্তিও তৈরি হয় একইসঙ্গে। এখানেও রয়েছে বিশেষত্ব। দেবনাথ বাড়িতে নীল জগন্নাথ ছাড়াও আরও এক ব্যতিক্রমী মূর্তি রয়েছে। তিনি স্বয়ং সুভদ্রা। অন্য কোথাও সুভদ্রার ত্রিনেত্র দেখা যায় না। তবে এখানে সুভদ্রার ত্রিনেত্র স্পষ্ট। এমনকি তাঁর পুজোও হয় তন্ত্রমতে। মহাবিদ্যার অন্যতমা দেবী ভুবনেশ্বরীকে কল্পনা করেই আরাধনা করা হয় দেবী সুভদ্রার।
আরও শুনুন: রথযাত্রায় জগন্নাথ যান গুণ্ডিচায়, সে সময় কি শূন্য থাকে শ্রীমন্দির?
প্রভুর ভোগেও রয়েছে ব্যতিক্রমের ছোঁয়া। এঁদের মতে, নূপুর দেবী স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন সেই বিশেষ ভোগের। যদিও শুনতেই বিশেষ, তার আয়োজন খুবই সাধারণ। আসলে এই নীল জগন্নাথ সবথেকে তুষ্ট হন ফ্যান ভাত আর ডাল সিদ্ধ, এই দুই খাবারে। তাই প্রতিদিন আর যাই ব্যবস্থা হোক, এই দুটি পদ প্রভুর ভোগে থাকবেই। মূলত অরহড় ডাল সিদ্ধ প্রভুকে দেওয়া হয়। সেইসঙ্গে থাকে পোলাও, পরমান্ন, মালপোয়া সহ একাধিক পদ। তবে আলু, টমেটো ইত্যাদি বেশ কিছু সবজি কোনওভাবেই ভোগে ব্যবহার করা হয় না। প্রভুর রথও একেবারে বাংলা রথের ধাঁচেই তৈরি। তবে বিশেষ কারণে চলতি বছরে প্রভু রথে আসীন হবেন না। তিনি মাসির বাড়ির উদ্দেশে রওনা হবেন কোলে চড়ে। শুধুমাত্র রথ নয়, বছরভর আরও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় নীল জগন্নাথকে ঘিরে। সবক্ষেত্রেই থাকে বিশেষ পুজোর ব্যবস্থা। আর দূরদূরান্ত থেকে সেই পুজোয় অংশ নিতে হাজির হন ভক্তরা। এমনকি জাতি ধর্ম নির্বিশেষে এই নীল জগন্নাথের পুজোর শামিল হন সকলে। ক্রিশ্চানপাড়া নাম থেকেই স্পষ্ট, কেষ্টপুরের এই অঞ্চলে মূলত খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের বাস। তাঁরাও সাগ্রহে প্রভুর পুজোয় অংশ নেন।
সব মিলিয়ে চলতি বছরেও মহাসমারোহে আয়োজন করা হয়েছে নীল জগন্নাথের বার্ষিক উৎসব, তথা রথযাত্রা। আর অন্যান্যবারের মতো এবারেও সেই পুজোয় অংশ নিতে হাজির হবেন অনেকেই, এমনটাই আশা দেবনাথ পরিবারের।