‘উৎকলে নাভিদেশশ্চ বিরিজাক্ষেত্রমুচ্চতে/ বিমলা মা মহাদেবী, জগন্নাথস্ত ভৈরব।’
পীঠনির্ণয় তন্ত্রের এই আখ্যান, শ্রীমন্দিরের কর্ত্রীকে বর্ণনা করে। তিনি দেবী মহামায়ার অংশ, ৫১ সতীপীঠের অন্যতমা দেবী বিমলা। জগন্নাথের ভোগ সবার আগে সমর্পন করা হয় তাঁকেই। দেবীর পুজো হয় তন্ত্রমতে। তাঁর দর্শন না করা অবধি জগন্নাথ দর্শন সম্পূর্ণ হয় না। কিন্তু ভিন্নমতাবলম্বী এই দেবীপীঠ জগন্নাথ মন্দিরেই কেন গড়ে উঠল? নাকি এই মন্দিরকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে শ্রী ক্ষেত্র? আসুন শুনে নিই।
জগন্নাথ শ্রী বিষ্ণুর রূপ। বৈষ্ণব হিসেবেই তিনি সর্বজনবিদিত। কিন্তু তাঁর মন্দিরে রয়েছে দেবী মহামায়ার মন্দির। যা সতীপীঠেরও অন্যতম। এই মন্দিরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী বিমলা শ্রী মন্দিরের শক্তিস্বরূপা। প্রভু জগন্নাথ তাঁর ভৈরব হিসেবে অবস্থান করেন।
আরও শুনুন: স্বয়ং বুদ্ধই কি নতুন রূপে এলেন প্রভু জগন্নাথ হয়ে! কী ব্যাখ্যা শাস্ত্রের?
শ্রীমন্দিরে চত্বরেই দেবী বিমলার মন্দির। সম্পূর্নভাবে বেলেপাথর আর ল্যাটেরাইটে তৈরি এই মন্দিরের চারটি অংশ। মন্দিরের দেওয়াল জুড়ে দশমহাবিদ্যার চিত্র খোদাই করা। মন্দিরের সেই কারুকাজ দেখার মতো। পুরাণমতে, এখানে সতীর ডান পায়ের কড়ে আঙুল পড়েছিল। যদিও অনেকেই এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। শৈব বিশ্বাস অনুযায়ী এই দেবীর ভৈরব জগন্নাথ। এক্ষেত্রে তাঁর প্রকাশ শিবরূপে। আর শ্রীমন্দিরে তাঁরা শিব-শিবানী হিসেবে অবস্থান করেন। দেবী বিমলা ভক্তিকামী। ভগবদ-অভিলাষী মানুষোকে পবিত্র করেন তিনি। তাঁর মূর্তির রূপ মহিষমর্দিনী। সারা বছরই দেবীর পুজো হয় তন্ত্রমতে। তবে মূল উৎসব হয় দুর্গাপুজোর সময়। আশ্বিন মাসে টানা ষোলো দিন বিভিন্ন রূপে দেবীকে অর্চনা করা হয়। বছরের অন্যান্য দিন জগন্নাথের নিরামিষ ভোগ তাঁকে অর্পন করা হয়। কিন্তু দুর্গাপুজোর সময় তাঁকে আমিষ ভোগ নিবেদনের নিয়ম রয়েছে। বিশেষভাবে স্থানীয় কুণ্ড থেকে মাছ এনে ভোগ নিবেদন করা হয় দেবীকে। তবে পুজোর সময় তিনদিন দেবী মন্দিরে মেষ বলিও হয়। খুবই গুপ্ত পদ্ধতিতে এই সময় দেবীর পুজো হয়। বৈষ্ণব মন্দিরের মেঝেতে সেই মেষ স্পর্শ করানো হয় না। বাঁশের সিঁড়ি ব্যবহার করে বিশেষ ভাবে দেওয়া হয় বলি। এই সময় মন্দিরে প্রবেশাধিকার পান না মহিলারা। মনে করা হয়, দেবীর উগ্র রূপ তাঁরা সহ্য করতে পারবেন না। তাই এই নিয়ম চালু রয়েছে মন্দিরে। এমনই আরও অনেক কিংবদন্তি প্রচলিত রয়েছে দেবী বিমলা সম্পর্কে।
আরও শুনুন: রথযাত্রায় জগন্নাথ যান গুণ্ডিচায়, সে সময় কি শূন্য থাকে শ্রীমন্দির?
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, জগন্নাথ মন্দিরেই কেন শক্তী পীঠ প্রতিষ্ঠিত হল?
এ প্রসঙ্গে একাধিক শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা রয়েছে। তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় উৎকল প্রদেশের একটি লোককথা। যেখানে মূলত শ্রী বিষ্ণু ও শিবের উল্লেখ মেলে। কথিত আছে, বিষ্ণুকে প্রাণভরে দর্শনের জন্য মহাদেব একবার বৈকুণ্ঠে হাজির হন। সেই সময় বিষ্ণু আহারে বসেছেন। যা দেখে শিবের ইচ্ছা হয় নারায়ণের প্রসাদ গ্রহন করবেন। কিন্তু নারায়ণের আহার গ্রহণের পর প্রায় কিছুই আর অবশিষ্ট ছিল না। অগত্যা নারায়ণের থালায় পড়ে থাকা সামান্য অংশ মুখে দেন তিনি। এবং নারায়ণের ভাবে তিনি এতটাই আবিষ্ট ছিলেন যে সেই প্রসাদের প্রায় অনেকটাই তাঁর মুখে লেগে যায়। কৈলাসে ফিরে নারদকে দেখতে পান মহাদেব। বিষ্ণুভক্ত নারদ মহাদেবের মুখে লেগে থাকা প্রসাদ দেখেই বুঝতে পারেন এই প্রসাদ তাঁর উপাস্যের। সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে প্রসাদ নিয়ে মুখে পোড়েন তিনি। এমন সময় দেবী পার্বতীও সেখানে উপস্থিত হন। নারায়ণের প্রসাদ তাঁরও চাই, এমনই দাবী করেন স্বামীর কাছে। কিন্তু শিব তো অপারগ। তাঁর নিজেরই ঠিক মতো প্রসাদ গ্রহণ হয়নি। যেটুকু অবশিষ্ট ছিল, তা নারদ গলাদ্ধকরণ করেছেন। অগত্যা পার্বতী হাজির হন নারায়ণের কাছে। সব শুনে নারায়ণ তাঁকে আশ্বস্ত করেন। পুরুষোত্তম ক্ষেত্রে তাঁর শক্তি রূপে অবস্থান করবেন দেবী। এবং নারায়ণের প্রসাদ সবার আগে তাঁকে অর্পন করা হবে। যে প্রথা আজও এতটুকু বদল হয়নি। দেবী বিমলাকে অর্পন করার পরই জগন্নাথের প্রসাদ হয়ে ওঠে মহাপ্রসাদ। আবার এমনটাও শোনা যায়, জগন্নাথ মন্দির প্রতিষ্ঠার বহু আগে থেকেই ওই স্থানে দেবী বিমলার মন্দির রয়েছে। বরং তাঁর বদান্যতাতেই ত্রিমূর্তি শ্রীমন্দিরে প্রতিষ্ঠিত হন। এবং সেখানে নাকি বিমলা দেবীকে জগন্নাথের ভোগ নিবেদনের প্রসঙ্গও উল্লেখ ছিল। মন্দিরের সেবায়েতরাও এই ভোগ নিবেদন ঘিরে বিভিন্ন অলৌকিক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন। দূরদূরান্ত থেকে শ্রী মন্দিরের এই দেবীকে দর্শন করতে আসেন ভক্তরা। আর দেবীর কৃপায় সুখ সমৃদ্ধি লাভ করেন সকলে।