সাক্ষীগোপালের কথা আমরা সকলেই শুনেছি। পুরীধামে যাঁরা যান, তাঁরা গোপালের এই ত্রিভঙ্গ-বঙ্কিম মুরলীধর মোহনরূপ দর্শন করেন। ভগবানের সাক্ষীগোপাল হয়ে ওঠার নেপথ্যে আছে এক গল্প। আজ শুনে নেব সেই কাহিনি।
সন্ন্যাস নেওয়ার পর মায়ের আদেশে শ্রীচৈতন্যদেব যখন নীলাচলে গিয়েছিলেন, তখন বহু পুণ্যস্থান দর্শন করেছিলেন। তাঁর ছায়াসঙ্গী নিত্যানন্দ মহাপ্রভু ছিলেন অবধূত সন্ন্যাসী। তিনি আগেই এই সমস্ত স্থান ঘুরে দেখেছিলেন। সেই সব স্থানের মাহাত্ম্যও জানা ছিল তাঁর। নবীন সন্ন্যাসী চৈতন্যদেবকে তিনিই শুনিয়েছিলেন সাক্ষীগোপালের কাহিনি। ভগবান যে ভক্তের জন্যই নিবেদিত প্রাণ, এ কাহিনি যেন সেই সারকথাই তুলে ধরে।
আরও শুনুন: রাম নাম লেখা পাথরও ভাসে জলে, রামের প্রতি ভক্তিতেই জন্ম অজস্র জনশ্রুতির
সাক্ষীগোপালের হয়ে-ওঠার নেপথ্যে আছেন জনৈক ধার্মিক ব্রাহ্মণ। একদা তিনি বৃন্দাবন ধামে তীর্থযাত্রায় গিয়েছিলেন। সঙ্গী ছিলেন আর-এক ধার্মিক যুবক। যুবকের সেবায় ব্রাহ্মণ অত্যন্ত খুশি হয়ে ঠিক করেন যে, নিজের কন্যার সঙ্গে তাঁর বিয়ে দেবেন। যুবককে সে-কথা তিনি জানান। যুবকটি বংশগৌরবে ব্রাহ্মণের সমকক্ষ ছিলেন না। তিনি তাই বারবার বলতে থাকেন যে, এরকম প্রতিজ্ঞা না করাই ভাল। কিন্তু ব্রাহ্মণ তাঁর কথা শুনলেন না। নিজের সংকল্পেই স্থির থাকলেন। এদিকে তীর্থযাত্রা শেষে যখন তিনি নিজের দেশে ফিরলেন তখন বাধল এক গোলমাল। ব্রাহ্মণের আত্মীয়স্বজন, গ্রামের মানুষ কিছুতেই এই প্রস্তাব মেনে নিলেন না। এত বাধার সম্মুখীন হতে হল তাঁকে যে, তাঁর প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হওয়ার জোগাড় হল। ব্রাহ্মণ এতে মনে মনে যারপরনাই দুঃখ পেলেন। এই অবস্থা দেখে যুবক আবার গেলেন বৃন্দাবনে। সেখানে গোপালের মন্দিরের সামনে করজোড়ে প্রার্থনা করে বললেন, এ বিষয়ে ভগবান স্বয়ং যেন সাক্ষী দেন। নইলে ব্রাহ্মণের সত্য রক্ষা হয় না। ভগবান ভক্তের এই আর্তিতে সাড়া দিলেন। জানালেন, তিনি সাক্ষী দিতে দূর সেই গ্রামে যাবেন। তবে শর্ত একটাই। যুবক আগে আগে যাবেন, আর তাঁর পিছনে পিছনে আসবেন ভগবান স্বয়ং। যুবক সানন্দে রাজি হয়ে হাঁটা শুরু করলেন। যত পথ এগোন পিছন থেকে নূপুরের ধ্বনি পান। বুঝতে পারেন ভগবান তাঁর সঙ্গেই আছেন। আনন্দিত মনে তিনি অনেকটা পথ পেরিয়ে এলেন। হঠাৎ একদিন তাঁর মনে হল, যাঁকে সাক্ষী দিতে ডাকলেন, তাঁর স্বরূপ তো দেখা হল না। এই না ভেবে ভুলক্রমে যেই না তিনি পিছু ফিরে তাকিয়েছেন, অমনি শর্ত ভঙ্গ হল। নূপূর-ধ্বনি আর শোনা গেল না। নিজের ভুল বুঝতে পেরে যুবক বারবার ক্ষমা চাইলেন ঈশ্বরের কাছে। ভক্তের আর্তিতে এবারও প্রসন্ন হলেন ভগবান। জানালেন, শর্তের কারণেই তিনি আর যুবকের সঙ্গে যেতে পারবেন না। তবে ওই স্থানেই তিনি অবস্থান করে ব্রাহ্মণের সত্যরক্ষায় সাক্ষ্য দেবেন। এদিকে ভগবানের এই আবির্ভাবে তখন সকলেই চমকিত হলেন। এরপর আর বিয়েতে কেউ আপত্তি করলেন না। যুবক ও তাঁর স্ত্রী পরবর্তী সময়ে গোপালের অর্চনা করেই পরম পুণ্য লাভ করেন।
শুনে নিন: আছে ‘পাপমোচন কুণ্ড’, বছরে একদিনই দর্শন মেলে কামাখ্যার বিশেষ শিবলিঙ্গের
শোনা যায় বিদ্যানগর নামক এক স্থানেই সাক্ষীগোপালের আবির্ভাব হয়েছিল। পরবর্তীকালে তা স্থানান্তরিত হয় কটকে। বর্তমানে পুরীর কাছে সাক্ষীগোপালের নামঙ্কিত স্থানেই তাঁর অবস্থান। এই কাহিনি অবশ্য নেহাতই যুবকের বিয়ের সাক্ষ্যদানের গল্প নয়। জাত-পাতের যে সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে মানুষ নিজেকে আবদ্ধ করে রাখে, ভগবান স্বয়ং সেদিন সাক্ষী দিয়ে যেন সেই গণ্ডিটিকেই নস্যাৎ করেছিলেন। রক্ষা করেছিলেন ব্রাহ্মণের সত্য। কায়মনোবাক্যে ঈশ্বরকে ডাকলে তিনি যে প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রামেও স্বয়ং পাশে থাকেন, সাক্ষীগোপালের এই কাহিনি যুগে যুগে ভক্তজনের কাছে এই সত্যই তুলে ধরে।