যিনি রাম, যিনি কৃষ্ণ, তিনিই এসেছিলেন এ যুগে রামকৃষ্ণ হয়ে। ঠাকুরের সেই অপরূপ লীলার সাক্ষী গোটা বিশ্ব। এদিকে ঠাকুরের লীলার পাশে পাশেই বয়ে চলে আর এক লীলামাধুরীর অপূর্ব স্রোত। সে লীলা শ্রীশ্রীমায়ের। ঠাকুরের কাছে তিনি দেবী, তিনি দশমহাবিদ্যার অংশ ষোড়শী। আবার ভক্তের কাছে তিনি মাতৃস্বরূপা। আসুন শুনে নিই।
শ্রীশ্রীমা সারদা বলতেন, তিনি সকলের মা। তাঁর কাছে কেউ ছোট-বড় নেই, উচ্চ-নীচ নেই। নরনারায়ণ সেবার মন্ত্র একদিকে ভক্তদের উদ্বুদ্ধ করেছেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ। জগতের প্রয়োজনে বদলে দিয়েছেন ধর্মের অভিমুখ। আর মা সারদা যেন নিভৃতে বসে ঠাকুরের সেই দর্শনের একটি ব্যবহারিক রূপ তুলে ধরছেন জগতের সামনে। রক্ষণশীলতার বেড়াগুলিকে সরিয়ে দিচ্ছেন নিজের হাতে। খুলে দিচ্ছেন নতুন যুগের নতুন ধর্মের পথ।
আরও শুনুন: শক্তিপুজোয় বলির ইচ্ছা স্বামীজির, নিষেধ মা সারদার, কেন ছিল এই উৎসর্গের প্রথা?
শ্রীশ্রীমা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন আসল ধর্ম মানুষের ধর্ম। সেখানে আর্ত পীড়িত সকলেরই সমান অবস্থান। শ্রীশ্রীমা বলেন, ‘জগৎকে আপনার করে নিতে শেখো। কেউ পর নয়, মা, জগৎ তোমার।’ এই যে মা বললেন, ‘জগৎ তোমার’, এটাই যেন মায়ের শিখিয়ে দেওয়া মহামন্ত্র। জগৎকে আপনার করে নিতে জানলেই আসলে নরনারায়ণ সেবার উদ্দেশ্য পূরণ হয়। ঠাকুর যে দর্শনের সলতে জ্বালিয়েছিলেন, মা তার শিখাটিকে ছড়িয়ে দিলেন আমাদের মধ্যে। এ শুধু মায়ের কথার কথা নয়। কতবার নিজের কাজে মা তা প্রমাণ করে দিয়েছেন। তাঁর জীবনের দিকে তাকালেই স্পষ্ট হয়, এমন কোনও ভক্ত নেই যিনি মায়ের সংস্পর্শে এসেও শ্রদ্ধায় মাথা নত করেননি। স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর অনুমতী ব্যতীত একটা পা ফেলতেন না বলা যায়। বেলুড় মঠের দুর্গাপুজোর হাজারও নিয়ম কানুন থেকে আরম্ভ করে বলি বন্ধ, সবেতেই ‘হেড অফিস’ যা নির্দেশ দিয়েছেন সেই মতো কাজ হয়েছে।
আরও শুনুন: বেলুড় মঠে প্রথমবার দুর্গাপূজায় ছিল না কিশোরী, সারদাকে দেবীরূপে পূজা করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ
শ্রীশ্রীমা, সকলের কাছে সারদাদেবী হিসেবে পরচিতা। মনে হতে পারে, এই উপাধি তাঁর সম্মানার্থে। আবার এও মনে হতে পারে, শ্রীরামকৃষ্ণ নিজের সহধর্মিণী সারদাকে দেবী হিসাবে পুজো করেছেন, তাই তিনি দেবী। কিন্তু শুধুই কি তাই? শ্রীশ্রীমার জন্মকাহিনি শুনলে কিংবা তাঁর জীবনের নানা অধ্যায়ের দিকে তাকালে এইটুকু কম মনে হতেই পারে। শোনা যায়, সারদা জন্মের আগে তাঁর মা স্বপ্নে দেবী জগদ্ধাত্রীকে দেখেছিলেন। দেবী স্বয়ং এসে তাঁকে বলছেন, কন্যারূপে তিনি চট্টোপাধ্যায় পরিবারে জন্ম নিতে চলেছেন। এমন উদাহরণ একটা নয়। দুর্ধর্ষ ডাকাত তাঁর মধ্যে খুঁজে পেলেন মা কালীকে। স্বামী পুজো করলেন ষোড়শীরূপে। সব মিলিয়ে তাঁর নামে দেবী স্রেফ সম্মানার্থে বা উপাধি হিসেবে বসেছে এমনটা বোধহয় বলা যায় না। এদিকে তিনি কর্মের জগতে যে অবদান রাখছেন, তাঁর বাণী, তাঁর কার্যকলাপ যতই ঠাকুরের মাহাত্ম্য প্রচারকে কেন্দ্র করে হোক, আসলে সেখানে তিনি মাতৃরূপে ধরা দিয়েছেন। এক্ষেত্রেও একবার নয়, বারবার এমন ঘটনা ঘটেছে। স্বামী চলে গেলে তাঁর কী হবে, একথা না ভেবে সারদা ভাবতে বসলেন ভক্তকূলের কী হবে! কেউ যেন কষ্ট না পায় সেই ভাবনায় তাঁর প্রাণ কাঁদত শেষ দিন অবধি। সুতরাং জন্মের পর সারদা নামটি পেলেও শ্রীশ্রীমাকে সারদামণি চট্টপাধ্যায় হিসেবে হয়তো অনেকেই চেনেন না। দেবীর যেমন পদবী হয় না, মায়েরও তেমন পদবীর প্রয়োজন নেই। বলাই বাহুল্য, দেবী আর মা দুই শব্দ যেন একে অন্যের প্রতিরূপ। সুতরাং সংঘজননী সারদা একই দেহে যেমন দেবী, তেমনই মা-ও।