তিনি জগত সংসারের আদিগুরু। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তাঁর এক ইশারায় ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। সেই দেবাদিদেব মহাদেব কালীর পদতলে শায়িত। প্রচলিত ধারণা বলে, দেবীকে শান্ত করতেই এমনটা করেছিলেন স্বামী মহেশ্বর। কিন্তু শাস্ত্রে এর ব্যাখ্যা ঠিক কেমন? আসুন শুনে নিই।
বাংলার একান্ত নিজের দেবী তিনি। নাগরিক মার্জিত শ্রী তাঁর গায়ে লেগে নেই। তিনি যেন ঘরের সেই অবহেলিত কালো মেয়েটি। সবার চোখের খানিক আড়ালেই থেকে যাওয়া শ্যামা। আবার সমাজের প্রচলিত নিয়মেরও উল্টোপথে চলেন তিনি। যে সমাজ, স্ত্রীকে স্বামীর পদসেবা করতে শেখায়, সেখানে কালীর পদতলে শায়িত স্বয়ং দেবাদিদেব মহেশ্বর। এবং এক্ষেত্রে মহেশ্বরের পরিচয়ও দেবীর স্বামী হিসেবেই।
আরও শুনুন: লজ্জায় জিভ কাটা নাকি অন্য কিছু! কেন লোলজিহ্বা মা কালী?
বাংলা যে প্রচলিত কালীমূর্তি দেখা যায়, তার সবেতেই দেবীর পদতলে মহাদেবের দেখা মেলে। এর প্রচলিত ধারণা এই যে, দেবীকে শান্ত করতে এমনটা করেছিলেন দেবাদিদেব মহেশ্বর। কথিত আছে, ভয়ংকর ক্রধে উন্মত্ত দেবী কিছুতেই শান্ত হচ্ছেন না। তাঁর আরও রক্ত চাই। এদিকে আর একটিও দানব অবশিষ্ট নেই, যাকে সংহার করবেন দেবী। তখন স্বয়ং মহেশ্বর দেবীর পথ রোধ করে দাঁড়ান। কিন্তু আদ্যাশক্তির সেই রূপ এতটাই ভয়ংকর যে দেবাদিদেবও খানিক ভয় পেয়ে পিছিয়ে আসতে বাধ্য হন। কিন্তু দেবীকে শান্ত না করতে পারলে তো সৃষ্টির সবকিছুই ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই উপায় না বুঝে দেবীর সামনে সটান শুয়ে পড়লেন মহেশ্বর। খেয়াল না করে তাঁর উপর পা রাখলেন দেবী কালী। ব্যস, একটা মাত্র পা রেখেই থেমে গেলেন। লজ্জায় জিভও কেটে ফেললেন। সেই মূর্তিই প্রচলিত কালী। শাস্ত্রেও এই যুক্তির মান্যতা দেওয়া হয় না বললে ভুল হবে। দক্ষিণাকালীর ধ্যানেই সে উল্লেখ মেলে। বলা হচ্ছে,
“শবরূপ মহাদেব হৃদয়োপরি সংস্থিতাম্।।
শিবাভির্য্যোররাবভিশ্চতুদিক্ষু সমন্বিতাং।
মহাকালেন চ সমং বিপরীতরতাতুরাং।।”
আরও শুনুন: রক্ষাকালী, শ্যামাকালী, দক্ষিণাকালী… কোন বৈশিষ্ট্যে বদলে যায় মা কালীর রূপ?
অর্থাৎ, কালী শিবারূঢ়া। দেবীর একটি পা দেবাদিদেবের বুকে ন্যস্ত। তবে শাস্ত্রজ্ঞদের মতে দুটি উপাদান এই শিবারূঢ়া দেবীর বিবর্তনে সাহায্য করেছে। প্রথমত, পুরুষ ও প্রকৃতির তত্ত্ব। যার একদিকে, নির্গুণ ও নিষ্ক্রিয় পুরুষ। অন্যদিকে ত্রিগুণাত্মিকতা ও ক্রিয়াশীলা প্রকৃতি। এবং দ্বিতীয়ত, তন্ত্রের ‘বিপরীত রতাতুরা’ তত্ত্ব। পুরুষ ও প্রকৃতির মিলনই সৃষ্টির মূলকথা। শাস্ত্রমতে, মহাকালীও চৈতন্যময় মহাকাল শিবের সংযোগে সেই সৃষ্টিকর্মেই নিয়োজিতা। তিনি যে শিবের বুকের ওপর পা রেখে দাঁড়িয়ে আছেন, তার অর্থ পুরুষের বুক থেকেই শক্তির উদ্ভব হয়েছে। আবার এই পুরুষ বা শিবের সঙ্গে, কালীর সম্পর্কই হল বিপরীত রতিক্রিয়ার সম্পর্ক। অর্থাৎ পরম শূন্যতারূপ পুরুষের বুক থেকে নির্গত হয়ে পুরুষকে আবৃত করেই, জগৎ প্রসব করছেন শক্তি।
অন্যদিকে মহানির্বাণতন্ত্রে বলা হয়েছে,
‘কলনাৎ সর্বভূতানাং মহাকালঃ প্রকীৰ্ত্তিতঃ। মহাকালনা কলনাৎ তমাদ্যা কালিকা পরা।।’
অর্থাৎ, সর্বপ্রাণীকে ‘কলন’ অর্থাৎ গ্রাস করেন বলেই শিব ‘মহাকাল’। আর সেই মহাকালকেই গ্রাস করেন আদ্যাশক্তি ‘কালিকা’। কালকে কলন করেই তিনি কালী। তিনি অশুভ শক্তিনাশ করেছেন। গলায় তার প্রতীক হিসেবে পরেছেন দানবমুণ্ডমালা। দেবী কালী রুদ্রের ধ্বংসারিকা শক্তির যথার্থ প্রতিরূপা রুদ্রাণী। তবে রুদ্র বলতে শুধুমাত্রই ধ্বংসের দেবতা নন, তিনি শিবও বটে। সুতরাং কালীমূর্তিতে তাঁর প্রকাশ আবশ্যক। তাই কালীপূজোয় দেবাদিদেবের পূজাও আবশ্যক। ফুলের ক্ষেত্রেও মহেশ্বরের প্রিয় বেলপাতা ও আকন্দ ছাড়া কালীপুজো করা যায় না। সবমিলিয়ে একথাই বলা যায়, কালীমূর্তি শিব ছাড়া অসম্পূর্ণ।