দশভুজা। প্রত্যেক হাতে আলাদা অস্ত্র। তার মধ্যে ত্রিশূল বিদ্ধ করেছে মহিষাসুরকে। দেবী দুর্গার এই রূপ আমাদের সবার পরিচিত। দেবীর ধ্যান মন্ত্রেও ঠিক তেমনই উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু ‘দুর্গা’ মানেই স্রেফ অসুরদলনী নন। শাস্ত্রেই উল্লেখ রয়েছে দেবীর আরও কিছু রূপের কথা। আসুন শুনে নিই।
পিতৃপক্ষের অবসান ঘটিয়ে দেবীপক্ষের সূচনা। মহালয়ার পুণ্যতিথি। রেডিওতে সম্প্রচারিত হচ্ছে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। শ্রীশ্রীচণ্ডীর আখ্যানের সঙ্গে কিছু আগমনী গানের অপূর্ব মেলবন্ধন। শুনতে শুনতে মনে তৈরি হল দেবীর অসুরদলনী রূপ। কিছুদিনের মধ্যেই পাড়ার মণ্ডপে যে মূর্তি দেখে আপনা থেকে হাত ঠেকবে কপালে। হালের থিমপুজো হয়তো সেই ধরানা বদলেছে। আদি মাতৃকার রণচণ্ডী মূর্তি হয়তো অনেক জায়গাতেই দেখা যায় না। কিন্তু দুর্গা মূর্তির হাতে ত্রিশূল কিংবা পায়ের নীচে অসুর নেই, এমনটা সচরাচর দেখা যায় না বললেই চলে। কিছু না হোক, অন্তত প্রতীকী হিসেবে মহিষের কাটা মাথাটুকু তো থাকবেই। কিন্তু দুর্গা বলতে শুধুই কী এই বিশেষ মূর্তি। শাস্ত্র কিন্তু তেমনটা বলছে না।
আরও শুনুন: বধ করেছিলেন বিষ্ণু, তবু কেন মহামায়াকেই বলা হয় মধুকৈটভদলনী?
আসলে এই ‘দুর্গা’ নামের মধ্যে নানা ব্যঞ্জনা বিদ্যমান। এঁর মূলত দুটি রূপভেদ। একদিকে রয়েছেন পর্বত দুর্গের অধিষ্ঠাত্রী যোদ্ধ্রী। অন্যদিকে, তিনি মরুকান্তারবাসিনি পালয়িত্রী। আবার চণ্ডীমঙ্গলের অধিদেবতা যিনি, সেই দুর্গা বিন্ধ্যবাসিনী। তিনি অভয়া, অসুরদলনী নন। তাঁর পরিচয় মূলত লৌকিক দেবী রূপে। তাঁকে বনদেবীও বলা চলে। ইনি বৈদিক সাহিত্যের একেবারে শেষের দিকে আত্মপ্রকাশ করেন। আবার ঋগবেদে এঁর পরিচয় ‘অরণ্যানী’ রূপে। যিনি একদিকে পশুমাতা। আবার অন্যদিকে সুগন্ধী অন্নে এঁর ভাণ্ডার পরিপূর্ণ। সুতরাং দেবীর এই বিশেষ রূপটিকে, কৃষিজীবী ও পশুজীবী দুই ক্ষেত্রের সমন্বয় সাধিকা বলা চলে। শাস্ত্র বলছে, এই দেবী বাস করেন পর্বতে, নদীতে কিংবা গুহায়। স্পষ্টতই তিনি আরণ্যক জীবনে অভ্যস্ত। তবে তাঁর পুজোয় কোনও উচ্চবর্ণের দেখা মেলে না। মূলত শবর, পুলিন্দের আরাধ্যা মাতৃস্বরূপা। পরবর্তীতে আর্যীকরণের সুবাদে তিনিই হয়ে ওঠেন হিমালয় কন্যা পার্বতী। জায়ারূপে তাঁকে গ্রহণ করলেন মহেশ্বর। এরপর থেকে তিনিও হলেন কৈলাসবাসী। বাংলার ঘরে ঘরে দেবী দুর্গার বাপের বাড়ি আসার যে আখ্যান তা আসলে এই দেবী পার্বতীর হিমালয়ের রাজের গৃহে পদার্পণের ঘটনাকে মনে করায়। এখানেী তিনি আবার গণেশ জননী। লোকবিশ্বাসে দেবীর সন্তান রূপে ধরা দিচ্ছেন, কার্তিক, লক্ষ্মী এবং সরস্বতীও। মর্তে তাই সপরিবারে দেবী দুর্গার আরাধনা করা হয়। তবু এই কাহিনীতে মহিষাসুরের তো উল্লেখ নেই। তাহলে আমাদের পরিচিত যে দুর্গা মূর্তি, তাঁর সঙ্গেও এঁর কোনও মিল থাকার কথা নয়।
তাহলে দেবীর অসুরদলনী রূপের ব্যাখ্যা কোথায় মেলে?
আরও শুনুন: দেবীপক্ষের আগে চলে পিতৃপক্ষ, এই সময়ে কোন কাজ অবশ্য পালনীয়?
সে উত্তর মিলবে, মার্কণ্ডেয় পুরাণে। সেখানে মহিষাসুর, ধুম্রলোচন, শুম্ভ-নিশুম্ভকে বধ করার কৃতিত্ব দেওয়া হয়েছে দেবীকে। তবে সেই দেবী প্রথমোক্ত দুর্গা। চণ্ডকে বিনাশের সুবাদে তিনি দেবী চন্ডী। এই পুরাণেও রয়েছে আরেক দুর্গার উল্লেখ। তিনি দ্বিতীয়োক্ত দুর্গা। তাঁর পরিচয় জীবধাত্রী রূপে। ভাষাতত্ত্ববিদ আচার্য সুকুমার সেন মনে করেন, এই দেবীর পুজো পুরোপুরী না হলেও কিয়দংশে মিশে যায় দুর্গাচণ্ডীর পুজোর সঙ্গে। বৃক্ষপূজা বা নবপত্রিকা স্নান যার অন্যতম শরীক। দেবী মূলত শস্যদেবী। সেক্ষেত্রে নবপত্রিকা স্নানের রীতি এবং দেবী মূর্তির সঙ্গে এই বিশেষ বৃক্ষের অংশগুলি মিলিতভাবেই অর্চনা করা হয়। ঐতিহাসিক রমাপ্রসাদ চন্দের ভাষায়, ‘মহিষাসুরমর্দিনীর পূজার মুখ্য উদ্দেশ্য হল শস্য উৎপাদনের এবং রক্ষার জন্য বসন্তে এবং শরতে শাকম্ভরীর প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং আনন্দ উৎসব।’ আসলে এই দেবী শাকম্ভরীর অর্চনার সুবাদেই নবপত্রিকায় নয় ধরনের পত্রিকা রাখার নিয়ম। কলাগাছ, গুঁড়ি-কচুর গাছ, হলুদ গাছ, জয়ন্তীর ডাল, বেলের ডাল, দাড়িম গাছ, অশোকের ডাল, মানকচুর গাছ ও ধানের গাছ। এই ন-টি গাছ আবশ্যক নবপত্রিকা রচনায়। আর যার আরাধনা করা হয় দেবীরূপে।