“রণে বনে জলে জঙ্গলে, যখনই বিপদে পড়িবে, আমাকে স্মরণ করিও, আমিই রক্ষা করিব” – বাবা লোকনাথের এই বাণী মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন অনেকেই। কথিত আছে, মন দিয়ে বাবা লোকনাথের নাম স্মরণ করলে, সত্যিই যে কোনও বিপদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। অথচ তিনি কোনও দেবতা নন। জ্ঞানী, শাস্ত্রজ্ঞ, এক দীব্যপুরুষ যিনি নিজেকে কখনই ঈশ্বরের আসনে প্রতিষ্ঠা করতে চাননি। তাঁর না আছে তথাকথিত শিষ্যকুল, না আছে কোনও ধর্মীয় সংগঠন। স্রেফ ভক্তের বিশ্বাসে তিনি হয়ে উঠেছেন ভগবান। আগামী ৩রা জুন বাবা লোকনাথের তিরোধান দিবস। এইদিন সামান্য আয়োজনে তাঁর পুজো করলেই শুভাশুভ ফল মেলে। কী সেই নিয়ম? আসুন শুনে নিই।
তিনি শিব। তিনিই কালী। আবার তিনিই নারায়ণের অংশ। ভক্তের কাছে তিনিই বিভিন্ন দেবতার স্বরূপ। অথচ এই দেবত্ব প্রাপ্তির দাবি লোকনাথ নিজে কখনও করেননি। জাতপাতের উর্ধে গিয়ে, তৎকালীন সমাজকে স্রেফ মনুষ্বত্যের পাঠ পড়াতে চেয়েছিলেন। যার জন্য তাঁকে সহ্য করতে হয়েছিল গোঁড়া সমাজের লাঞ্ছনা, কটূক্তি এমনকি অবহেলাও। কিন্তু সবকিছু উপেক্ষা করে তা সম্ভবও করেছিলেন তিনি। এই কারণে অনেকের কাছেই তিনি দেবতার সমতুল্য। তাঁর বাণী, জীবনদর্শন আজও অনেকেরই জীবনের পাথেয়।
আরও শুনুন: কামাখ্যার অম্বুবাচী মেলায় সমাগম বহু ভক্তের, কী রহস্য এই মেলাকে ঘিরে?
দেবজ্ঞানে বাবা লোকনাথের পুজো হয় মূলত দুটি দিনে। প্রথমটি তাঁর জন্মতিথি, অর্থাৎ জন্মাষ্টমীর দিন। সেদিন শ্রীকৃষ্ণেরও জন্মতিথি। তাই সেই অর্থে জন্মাষ্টমী তিথিতে লোকনাথ পুজোর আধিক্য বিশেষ চোখে পড়ে না। কিন্তু বছরে আর একটি দিন বাবা লোকনাথের পুজো হয় বেশ জাঁকজমক করেই। দিনটি ১৯ জ্যৈষ্ঠ, ইংরাজির ৩রা জুন। এই দিনেই বাবা লোকনাথ চির সমাধিতে শায়িত হয়েছিলেন। তাঁর এই তিরোধান দিবসেই ঘরে ঘরে লোকনাথ পুজোর আয়োজন করেন অনেকেই। ভক্তের বিশ্বাস, নিষ্ঠাভরে এইদিন বাবা লোকনাথের পুজো করলে জীবন সুখ সমৃদ্ধিতে ভরে ওঠে। এইদিন বিভিন্ন লোকনাথ মন্দিরেও পুজোর আয়োজন করা হয়। সেইসঙ্গে ব্যবস্থা করা হয় নরনারায়ণ সেবার। বাবা লোকনাথ চিরকাল গরীব দুঃখী-র পাশে থেকেছেন। কেউ সোনার আসন পেতে দিলে বাবা সেখানে বসতেন না। মাটির কুটিরে সুতির আসনই যথেষ্ট। তাই বাবার পুজোয় অভুক্তকে পেট ভরে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেন অনেকেই। পশ্চিমবঙ্গে এমন লোকনাথ মন্দিরের সংখ্যা নেহাতই কম নয়। কলকাতা বা শহরতলীতেও এই মন্দির যথেষ্টই চোখে পড়ে। তবে বাবা লোকনাথের সবথেকে বড় মন্দির রয়েছে চাকলা ও কচুয়া ধামে। এখানেই বাবার জন্মস্থান। তবে দেশের বাইরেও বাবা লোকনাথের বিশাল এক মন্দির রয়েছে। বাংলাদেশের বারদী গ্রামে বাবা লোকনাথের সেই মন্দির খুবই জনপ্রিয়। কথিত আছে, এই গ্রামেই দেহ রেখেছিলেন বাবা লোকনাথ। সেই স্থানেই বর্তমানে গড়ে উঠেছে বিশাল মন্দির। সারা বছরই এখানে ভক্তরা ভিড় জমান। তবে তিরোধান দিবসে বিশেষ পুজোর আয়োজন করা হয়।
আরও শুনুন: উপোসে অসুবিধা! নির্জলা একাদশীতে কী করলে মেলে বিশেষ ফল?
তবে বাবা লোকনাথের এই দেবত্বপ্রাপ্তির নেপথ্যে বেশ কিছু অলৌকিক ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। সেই অর্থে যার বাখ্যা কোনও শাস্ত্রে নেই, তবে লৌকিক বিশ্বাসের চেয়ে বড় বোধহয় আর কিছু হতে পারে না। তাই বাবা লোকনাথের সমস্ত অলৌকিক ঘটনাই লোকমুখে প্রচারিত হয়েছে। কেউ কেউ এমনটাও দাবি করেছেন, তাঁর লীলা স্বচক্ষে দেখেছেন। তবে অনেকেই যে মন থেকে তা অনুভব করেছেন একথা বলাই বাহুল্য। বাবা লোকনাথ নাকি ১৬০ বছরেরও বেশি সময় জীবিত ছিলেন। এমনকি জীবদ্দশায় নিজের মায়ের পূনর্জন্ম হতেও দেখেছিলেন। শুধু তাই নয়, বেদ-কোরান-বাইবেল সব কিছুই তিনি পড়েছিলেন। বুঝেছিলেন, সব ধর্মের সারকথা একই। আর সেই ধারণা সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন বাবা লোকনাথ। সেইসঙ্গে সাধনার জেরে অর্জন করেছিলেন দীব্যক্ষমতা। যার বলে তিনি ভক্তদের যে কোনও বিপদে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিতেন। মৃত্যুর ঠিক আগের মুহূর্তেও সেই অমোঘ বাণীই উচ্চারণ করেছিলেন বাবা লোকনাথ।
সেই আশ্বাস অনেকেই অবিশ্বাস করতে পারেন। তবে কথায় আছে, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর। স্রেফ এই বিশ্বাসের নৌকায় ভর করেই কতজন জীবনের কঠিনতম বিপদের দিনগুলো কাটয়ে দেন। আপাতভাবে মনে হতে পারে, এই বিশ্বাস আসলে নিজের উপর। কিন্তু তারও তো কিছু নিমিত্ত থাকা প্রয়োজন। আর সেই নিমিত্ত বোধহয় বাবা লোকনাথের মুখ নিঃসৃত বাণী। যা আসলে যে কোনও বিপদে নিজেকে শক্ত রাখার পাঠ শেখায়। আর সেই জোরেই জয় হয় জীবনযুদ্ধে।