বইনির্ভর জ্ঞান কিংবা কাগজে পড়া খবরের প্রতি অগাধ আস্থা ভদ্রলোক শিক্ষিত বাঙালির। কিন্তু রামকৃষ্ণ মনে করতেন, পড়ার চেয়ে শোনা ভালো, আর তার চেয়েও কার্যকর হল নিজের চোখে দেখা। আজকের দিনে যখন নিজের দেখা আর গণমাধ্যমের দেখানোর মধ্যে ফাঁক রচিত হচ্ছে অনেকসময়েই, তখন সেই রামকৃষ্ণ-দর্শনকেই ভেবে দেখা জরুরি।
ভদ্রলোক শিক্ষিত বাঙালির কাছে বইপত্রনির্ভর জ্ঞানের বাড়তি গুরুত্ব আছে। একইরকম বিশ্বাস সংবাদপত্রের প্রতিও। ব্রিটিশ শাসনের দরুন যে ভদ্রলোক চাকুরিজীবী শ্রেণির উদ্ভব হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত হয়েছিল। রেনেসাঁস পর্বে বহু জ্ঞানীগুণী মানুষই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্ত ছিলেন। তাঁর বাণীতে আশ্রয় পেয়েছিলেন। অথচ ঠাকুর কি সেই ভদ্রলোকীয় বৈশিষ্ট্যগুলিকে খুব গুরুত্ব দিতেন? তাঁর ভাষা, বক্তব্যের ধরনে বরং এর একটা বিপরীত ধরনই স্পষ্ট ছিল।
-: আরও শুনুন :-
মতের ভিন্নতাকে দেন স্বীকৃতি, একমাত্রিক দেশনির্মাণের পালটা বয়ান হতে পারেন শ্রীরামকৃষ্ণই
অথচ রামকৃষ্ণ-ভক্তি যে ক্রমে ‘শহুরে গার্হস্থ্য জীবনের ধর্ম’ হয়ে উঠল, তা মূলত এই ভদ্রলোক শ্রেণির কল্যাণেই। ইতিহাসবিদ সুমিত সরকার বলেন, “রামকৃষ্ণ ভদ্রলোক সমাজেরই আয়ত্তাধীন ও অংশত তাঁদেরই গড়া একটি অন্য সত্তা যাঁর সঙ্গে নিজেদের শিকড় থেকে বিযুক্তির যন্ত্রণায় গ্লানিগ্রস্ত এক নাগরিক গোষ্ঠী স্বচ্ছন্দে আত্মীয়তা বোধ করতে পারেন।” একদিকে চাকুরির কল্যাণে এই ভদ্রলোক সমাজের জীবনের বদল, অন্যদিকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দরুন গ্রামীণ অঞ্চলে বিদ্রোহের সূত্রপাত। এই বিক্ষুব্ধ পরিস্থিতির মধ্যবর্তী এক সেতু হয়েই যেন ভদ্রলোক গোষ্ঠীর কাছে আশ্রয় হয়ে উঠলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। সুমিত সরকার তাই বলেন, “রামকৃষ্ণ-ভক্তি ভদ্রলোকদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ও কাজকর্মে কোনও তীক্ষ্ণ বা পূর্ণচ্ছেদ ঘটায়নি। সেই স্বাভাবিক জীবনধারা অব্যাহতই থেকে গেল, তাতে একটা নতুনত্ব এল মাত্র, কালোপযোগী এক আধ্যাত্মিকতা ও অন্তর্জীবনের সমৃদ্ধিযোগে।… তাঁর গ্রাম্য ভাষায় সরল বিশ্বাসের বাণীর মধ্য দিয়ে শহরের ভদ্রলোকেরা কল্পনায় গ্রামদেশে তাঁদের পুরুষানুক্রমিক শিকড়ের কাছে ফিরে যেতে পারতেন।” আর তাই ভদ্রলোক সমাজে যথেষ্ট আদৃত হলেও রামকৃষ্ণ খুব খোলাখুলিই বলতেন যে, “অনেকে মনে করে, বই না পড়ে বুঝি জ্ঞান হয় না, বিদ্যা হয় না। কিন্তু পড়ার চেয়ে শুনা ভাল, শুনার চেয়ে দেখা ভাল। কাশীর বিষয় পড়া, কাশীর বিষয় শুনা, আর কাশীদর্শন অনেক তফাত।” নিজের সম্পর্কে তাই তাঁর বলতে দ্বিধা ছিল না যে, “আমি তো বই-টই কিছুই পড়িনি, কিন্তু দেখ মার নাম করি বলে আমায় সবাই মানে।” খানিকটা বিচলিত, বিব্রত ভদ্রসমাজকে তিনি যে ভক্তির সন্ধান দিতে চেয়েছিলেন, তার সহায়ক হিসাবেই দেখা যায় তাঁর এই দর্শনকে। সেই রেনেসাঁস পর্বের তাবড় পণ্ডিত বিস্তর বইপত্র শাস্ত্র ঘেঁটেও যে শান্তির হদিশ পাননি, রামকৃষ্ণের কাছে তা পাওয়া যেত। ফলত বইপত্রনির্ভর জ্ঞানকে তিনি বড় একটা আমল দেননি। এমনকী এই বিশ্বাস তিনি অনুগতদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন যে, যাবতীয় বইপত্র সব তাঁর মুখেই।
অতএব ভদ্রলোক সমাজের কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়ে রসিকতা করতেও তিনি পিছপা হননি। ‘কথামৃত’ শোনায় সেরকমই একটি গল্প। ইংরাজি বিজ্ঞানশাস্ত্রে যা নেই তা শিক্ষিত বাবুরা বিশ্বাস করবেন কী করে? এই আলাপচারিতার প্রসঙ্গেই শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, ” একটা গল্প শোন- একজন এসে বলল, ওহে! ও পাড়ায় দেখে এলুম অমুকের বাড়ি হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে গেছে। যাকে ও কথা বললে- সে ইংরাজী লেখাপড়া জানে, সে বললে দাঁড়াও একবার খপরের কাগজখানা দেখি। খপরের কাগজ পড়ে দেখে যে বাড়ি ভাঙার কথা কিছুই নাই। তখন সেই ব্যক্তি বললে, ওহে তোমার কথায় আমি বিশ্বাস করি না। কই, বাড়ি ভাঙার কথা তো খপরের কাগজে লেখা নাই। ওসব মিছে কথা।” এই বক্তব্যের পর কথামৃত সংক্ষেপে জানিয়েছে যে- সকলের হাস্য; অর্থাৎ ভদ্রলোক সমাজের এমন অন্ধবিশ্বাসে হেসে উঠেছেন তাঁরাই। বৈপরীত্য সত্ত্বেও ভদ্রলোক সমাজ ও শ্রীমাকৃষ্ণ দর্শনের এই নিবিড় সম্পর্ক তাই সব দিক থেকেই স্বতন্ত্র।
-: আরও শুনুন :-
যাহা জল তাহা পানি নয়! ‘মুসলমানী শব্দ’ ব্যবহার নিয়ে কী মত ছিল রবীন্দ্রনাথের?
তবে, ঠাকুরের সেদিনের কথাটার আজও ভেবে দেখার অবকাশ আছে বইকি! এই ভদ্রলোক সমাজের প্রসার বিস্তার হয়েছে আরও বৃহত্তর ভাবে। তবে, সেই খবরের কাগজে অটুট বিশ্বাস তো আজও বদলায়নি। নানা কারণেই গণমাধ্যমকে এখনও বহু বাধ্যবাধকতা মেনে চলতে হয়। সময় বদলালে তার স্বাধীনতার সূচকও বদলে বদলে যায়। আর এখানেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে শ্রীরামকৃষ্ণের কথাটি। সংবাদমাধ্যমের লেখা নিশ্চিতই গুরুত্বপূর্ণ; তবে তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ কি নয় যা চোখে দেখা যাচ্ছে? নিজের দর্শনে যা স্পষ্ট, আর যা দেখানো হচ্ছে, এই দুয়ের মধ্যে যদি পার্থক্য থেকেও থাকে, সেই ফারাক বুঝে নেওয়ার ভার ভদ্রলোক সমাজেরই। বিশেষত বর্তমানের এই ফেক নিউজের যুগে জল আর দুধের পার্থক্য করা যে সবিশেষ প্রয়োজন, তা বারবার বলা হয়ে থাকে। অতএব গার্হ্যস্থ ধর্মে যদি রামকৃষ্ণ-ভক্তি বাঙালি জীবনে শিরোধার্য হয়, তবে তাঁর দর্শনের এই দিকটিও বর্তমান ভদ্রলোক সমাজের গুরুত্ব দিয়েই ভেবে দেখা জরুরি হয়ে উঠছে দিন দিন।