স্বামীনিন্দা সহ্য করতে পারেননি সতী। পিতৃগৃহে সকলের সামনে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন দেবী। এদিকে প্রিয়তমাকে হারিয়ে ক্রোধন্মত মহেশ্বর তক্ষনি লণ্ডভণ্ড করে দেন দক্ষযজ্ঞ। এরপর সতীর দেহ কাঁধে তুলে শুরু করেন প্রলয়নৃত্য। তাণ্ডব থামাতে সুদর্শন চক্র ৫১ খন্ডে ভাগ করে সতীর দেহ। আর সেই সময় দেবীর যোনিখন্ড গিয়ে পড়ে কামাখ্যায়। প্রতিবছর অম্বুবাচী উপলক্ষে এই সতীপীঠে বিশাল মেলা বসে। কিন্তু স্রেফ ওই একটি উৎসব নয়। মা কামাখ্যার বিয়ে উপলক্ষেও বিশেষভাবে সেজে ওঠে নীলাচল পর্বতের মন্দির। কীভাবে পালিত হয় এই উৎসব? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
আসামের রক্ষাকর্ত্রী দেবী কামাখ্যা। প্রতি বছর দেশবিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভক্তরা এসে ভিড় জমান এই মন্দিরে। একাধিক অলৌকিক ঘটনার জেরে ভক্তি আর বিস্ময় এক হয়ে যায় এই মন্দিরে এলে। প্রতি বছর অম্বুবাচীর সময় বিশেষ উৎসব হয় মন্দির চত্বরে। সেইসময় দেবী ঋতুমতী হন। মন্দির বন্ধ থাকলেও এইসময় ভক্তদের ভিড় থাকে চোখে পড়ার মতো। তবে শুধুমাত্র এই উৎসব নয়। দেবী কামেশ্বরীর বিয়ে উপলক্ষেও সেজে ওঠে এই মন্দির।
আরও শুনুন: ছয় মাথা, আঠারো চোখ, দেবী কামাখ্যার এমন রূপের মাহাত্ম্য কী?
পুরাণে মহাদেবের বিয়ে নিয়ে একাধিক উপাখ্যান মেলে। বিশেষত হিমালয় কন্যা পার্বতীর সঙ্গে দেবাদিদেবের বিয়ে নিয়ে বেশ মজার কাহিনি শোনা যায়। কথিত আছে, বরের বেশে মহাদেবকে দেখে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন গিরিরাজের পত্নী মেনকা। কারণ সাধারণ কোনও বরের সাজে মহাদেব সেদিন আসেননি। তিনি এসেছিলেন ষাঁড়ের পীঠে চড়ে। সাড়া গায়ে ভস্ম মেখে, ভূত-প্রেত-দৈত্য-দানো এইসব অনুচরদের সঙ্গে নিয়ে। তবু পার্বতীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়েছিল। স্বয়ং ব্রহ্মা সেখানে পৌরহিত্য করেছিলেন। ঠিক সেই ধারা মেনেই কামাখ্যা মন্দিরে দেবীর বিয়ের আয়োজন করা হয়। প্রতি বছর পৌষমাসের কৃষ্ণপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে পুষ্যা নক্ষত্র যোগে এই বিয়ে হয়। অসমীয়া ভাষায় এর নাম ‘পোহন বিয়া’। পাত্রী দেবী কামেশ্বরী। পাত্র কামেশ্বর মহাদেব। হিন্দুমতে মেয়ের বাড়িতেই আসর বসে বিয়ের। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয় না। প্রথমদিন অধিবাস। সেদিন কামাখ্যা মন্দিরের কয়েকশো মিটার দূরে অবস্থিত কামেশ্বর মহাদেবের মন্দির থেকে দেবাদিদেবের চলন্তিকা মূর্তি পালকি করে দেবি মন্দিরে আনা হয়। মন্দিরের গর্ভগৃহে সেই মূর্তি স্থাপন করে গভীর রাত পর্যন্ত চলে পূজার্চনা। ষড়োশপচারে চলে পুজো। ধূপ ধুনোর গন্ধে ভরে ওঠে মন্দিরের চারপাশ। এইসময় গর্ভগৃহে প্রবেশের অনুমতি মেলে না দর্শনার্থীদের। বিয়ের আসল অনুষ্ঠান হয় দ্বিতীয় দিন। এদিন বিরাট এক শোভাযাত্রা বেরোয় মন্দির থেকে। সেখানে সবার আগে পালকি চড়ে আসেন দেবী কামেশ্বরী। এদিকে মন্দিরে কামেশ্বরকে ফুল মালায় সাজিয়ে তোলা হয়। যথাযময় মন্দিরে উপস্থিত হন পাত্রী, দেবী কামেশ্বরী। তবে এবার আর গর্ভগৃহ নয়, দেবীমূর্তিকে স্থাপন করা হয় পঞ্চরত্ন মন্দিরে। সেখানেই আসলে বিয়ের যাবতীয় অনুষ্ঠান হবে। বিয়ে চলাকালীন সেখানেই হয় বিশাল এক যজ্ঞের আয়োজন। বিয়ের নিয়মে এই যজ্ঞের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। এরপর একে একে সাত পাকে ঘোরা, খই ছড়ানো, ফুল ছোঁড়া সমস্ত আচার পালন করা হয় ভক্তিভরে। উলু আর শঙ্খের শব্দে মুখরিত হয়ে ওঠে মন্দির চত্বর। এমনকি বিয়ের গানও হয় এই বিশেষ অনুষ্ঠানে। সবশেষে ব্যবস্থা হয় বর-কনের ফুলশয্যা।
আরও শুনুন: লাল হয় ব্রহ্মপুত্রের জল, অম্বুবাচীতে মহামায়ার যোনিপূজা ঘিরে আর কী রহস্য রয়েছে?
এই উৎসবের দিন ভক্তদের জন্য বিশেষ ভোগের ব্যবস্থা করা হয়। মা কামাখ্যার সাধারণ যে নিত্যভোগ হয় তার থেকে খানিক আলাদা এই প্রসাদ। বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে থাকে পায়েস। বিয়ের অনুষ্ঠানের পর নবদম্পতি অর্থাৎ কামেশ্বর ও কামেশ্বরীকে এই পায়েস ভোগ দেওয়া হয়। মূল বিয়ের অনুষ্ঠান হয় পঞ্চরত্ন মন্দির আর ভদ্র মণ্ডপ মিলিয়ে। বছরের অন্যান্য সময় এই বিশেষ স্থান যত্ন করে পরিষ্কার করা থাকে। ভক্তরা সেখানেও ফুল দেন। তবে বিয়ের দিন মন্দিরের সাজসজ্জাই আলাদা। সাড়া বছর ভক্তরা অপেক্ষায় থাকেন এই উৎসবের জন্য। অম্বুবাচী ছাড়াও এই উৎসবের যথেষ্ট আকর্ষন রয়েছে স্থানীয়দের মধ্যে। এছাড়া যেসব পর্যটক একবার এই বিয়ের অনুষ্ঠান দেখেছেন তাঁরাও বারবার এই অভিজ্ঞতার সাক্ষী হতে চান। সেইসঙ্গে দেবী মাহাত্ম্য তো রয়েছেই। ভক্তিভরে দেবীকে স্মরণ করলে যে কোনও বিপদ থেকে মুক্তি মেলে।