প্রজাপতি ব্রহ্মার বরে পুত্র লাভ করেছিলেন এক ঋষি। কিন্তু পুত্রের আয়ু স্থির ছিল মাত্র সাত বছর। কিন্তু অপার শিবভক্তি বদলে দিয়েছিল নিয়তি। যে দেবতার বরে দশানন হয়ে উঠেছিলেন রাবণ। সেই মহেশ্বরের আশীর্বাদেই ঋষিপুত্র পেয়েছিলেন অমরত্বের বর। স্বয়ং যমরাজ এসেও ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন এই শিবভক্তের সামনে থেকে। এক বিশেষ মন্ত্রের জোরে এমনটা সম্ভব করেছিলেন ঋষিপুত্র মার্কণ্ডেয়। আসুন শুনে নেওয়া যাক সেই কাহিনি।
বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের অধীশ্বর তিনি। স্বয়ং শক্তি তাঁর অর্ধাঙ্গিনী। তাঁকে পরাস্ত করার ক্ষমতা ত্রিভুবনে কারওর নেই। সমুদ্র মন্থনে উঠে আসা বিষ কণ্ঠে ধারন করা থেকে শুরু করে ত্রিপুরাসুর বধ। দেবাদিদেব মহেশ্বরের বিভিন্ন লীলাখেলার কথা অল্পবিস্তর সকলেরই জানা। পুরাণ অনুযায়ী, তপস্যায় তাঁকে তুষ্ট করে অজেয় হওয়ার বর পেয়েছিলেন অসুর-রাও। মুনি ঋষিদের কাছেও তিনি ছিলেন পরম আরাধ্য। বরাবরই অল্পেতে তুষ্ট হন মহেশ্বর। এক্ষেত্রেও অন্যথা হয়নি। দুবছরের সাধনায় পরমায়ু লাভ করেছিলেন মার্কণ্ডেয়।
আরও শুনুন: নাগপঞ্চমী পালনে তৃপ্ত হন মহেশ্বরও, পুরাণমতে কীভাবে শুরু হল এই উৎসব?
পূরাণ মতে, বহুকাল পূর্বে মৃকাণ্ডু নামে এক ঋষি বাস করতেন। তিনি ছিলেন ধর্মপরায়ণ ও জিতেন্দ্রিয়। অর্থাৎ সমস্ত ইন্দ্রিয়কে জয় করতে পেরেছিলেন তিনি। তা সেই মৃকাণ্ড পুত্রলাভের আশায় বসলেন ব্রহ্মার তপস্যায়। দীর্ঘ তপস্যায় খুশি হলেন ব্রহ্মা। দিলেন বরও। তবে ওই একটা কিন্তু রয়েই গেল। প্রজাপতি ব্রহ্মা জানালেন, প্রবল ধার্মিক হওয়া সত্ত্বেও মাত্র সাত বছর বয়সে মৃত্যু হবে সেই পুত্রের।
যথাসময়ে পুত্রসন্তানের মুখ দেখলেন মৃকাণ্ডু। তবে দিনরাত তাঁকে তাড়া করে বেড়াত একটাই দুশ্চিন্তা। ব্রহ্মার সেই কথাগুলো কিছুতেই মন থেকে তাড়াতে পারছিলেন না মৃকাণ্ডু। ফের নতুন করে যে ব্রহ্মার তপস্যা করবেন, সে উপায় তাঁর নেই। অগত্যা ঋষি শুরু করলেন বিষ্ণুর আরাধনা। কিন্তু পুত্রের দীর্ঘজীবন লাভের বর দেওয়ার সাধ্য ছিল না স্বয়ং বিষ্ণুরও। ক্লান্ত অবসন্ন ঋষি মৃকাণ্ডুকে খালি হাতেই ফিরতে হল বিষ্ণুর কাছ থেকে।
আরও শুনুন: ‘আমাকে কি ত্যাগ করবেন?’ প্রশ্ন ধর্মত্যাগী মাইকেল মধুসূদনের, ঠাকুর বললেন…
এদিকে ছোট্ট মার্কণ্ডেয় বড় হতে লাগল ধীরে ধীরে। সে দেখে তার পিতার মনে সুখ নেই। সব সময়েই কীসের যেন দুশ্চিন্তা তাড়া করে বেড়াচ্ছে তাঁকে। শেষমেশ একদিন পিতার কাছে এসে কারণ জিজ্ঞেস করে বসল সে। কিন্তু ছেলেকে মুখ ফুটে কোনও কথাই বললেন না ঋষি মৃকাণ্ডু। শেষপর্যন্ত মায়ের কাছ থেকে মার্কণ্ডেয় জানতে পারলেন, তাঁর স্বল্পায়ুর কারণেই এমন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত তাঁর পিতা-মাতা। অবশেষে দীর্ঘজীবন লাভের আশায় নিজেই তপস্যায় বসার সিদ্ধান্ত নিল পাঁচ বছরের মার্কণ্ডেয়।
কিন্তু কীভাবে তপস্যা করবে ওইটুকু ছেলে? অবশেষে তাঁকে সাহায্য করলেন ঋষি পুলহ। মার্কণ্ডেয় সমস্ত কথাই জানাল তাঁকে। সব শুনে মহর্ষি পুলহ তাকে বলেন, জগতের গুরু মহেশ্বর। একমাত্র তিনিই পারবেন মার্কণ্ডেয়কে দীর্ঘজীবন লাভের বর দিতে। একইসঙ্গে তাঁকে মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র জপ করারও পরামর্শ দেন ঋষি। পুলহের কথামতো তপস্যা শুরু করল সেই বালক। গুরুর চরণ বন্দনা করে সে চলে গেল সাগর তীরে। সেখানেই মাটি দিয়ে সে তৈরি করল এক শিবলিঙ্গ। তার সামনে বসে শুরু হল মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্রের জপ।
আরও শুনুন: ‘আমাকে কি ত্যাগ করবেন?’ প্রশ্ন ধর্মত্যাগী মাইকেল মধুসূদনের, ঠাকুর বললেন…
এইভাবেই কেটে যায় বছর দুয়েক। ততদিনে সাতে পা দিয়েছে মার্কণ্ডেয়। যথাসময়ে মৃত্যুদূতদের তলব করলেন ধর্মরাজ যম। বিধির বিধানে মার্কণ্ডয়ের কাল পূর্ণ হয়েছে। তাকে মৃত্যুপুরীতে নিয়ে আসার আদেশ দিলেন ধর্মরাজ। যমের আজ্ঞা পেয়ে একদল যমদূত হাজির হল মার্কণ্ডেয়-র সামনে। ভয়ঙ্কর তাদের মূর্তি। তবে সেদিকে যেন ভ্রূক্ষেপই নেই মার্কণ্ডেয়র। একমনে ধ্যান করে চলেছে সেই ছোট্ট বালক।
যমদূতেরা তার প্রাণ নিতে উদ্যত হতেই ঘটল অদ্ভুত এক কান্ড। মাটির ওই শিবলিঙ্গের সামনেই প্রকট হলেন স্বয়ং মহেশ্বর। পঞ্চানন রূপ ধারণ করে মহাদেব সামনে দাঁড়াতেই ভয়ে চম্পট দিল যমদূতেরা। এরপর মার্কণ্ডেয়-র প্রাণ নিতে সেখানে হাজির হলেন স্বয়ং যমরাজ। কিন্তু মহেশ্বরের ক্রোধের সামনে থতমত খেয়ে গেলেন তিনিও। অবশেষে উপায় না দেখে ব্রহ্মার দ্বারস্থ হলেন যম। ওদিকে মহাদেবের ক্রোধাগ্নিতে তো তখন তিন লোক থরথর। মহাদেবকে শান্ত করতে অগত্যা এগিয়ে এলেন সমস্ত দেবতা। অবশেষে রাগ পড়ে মহাদেবের। দেবাদিদেব জানান, যে ভক্ত শিবলিঙ্গের সামনে বসে মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র জপ করবে, দীর্ঘজীবন লাভের বর পাবে সে। আর ভক্তিভরে সেই কাজ করেই মহাদেবকে সেদিন তুষ্ট করতে পেরেছিল বালক মার্কণ্ডেয়। পেয়েছিলেন অমরত্বের বরও।