জগন্নাথের রথযাত্রার পরের মঙ্গল-শনিবার হয় বিপত্তারিণী চণ্ডীর পূজা। ঘরে ঘরে এয়োস্ত্রী মহিলারা সংসারের কল্যাণে এবং বিঘ্ননাশের উদ্দেশ্যে করেন এই পূজা। সবকিছু তেরো সংখ্যায় নিবেদন করতে হয় দেবীকে। এই পূজার মতো প্রায় একই পূজার উল্লেখ রয়েছে মহাভারতে। মল্ল রাজাদের আমলে এক অলৌকিক কাহিনি জুড়ে আছে এই ব্রতর সঙ্গে। শোনাচ্ছেন সতীনাথ মুখোপাধ্যায়।
প্রভু জগন্নাথস্বামী রথে চেপ গিয়েছেন মাসির বাড়ি। সেখানে থাকবেন সাত দিন। ফিরবেন উলটো রথে। রথযাত্রা থেকে উলটো রথের মধ্যের মঙ্গল ও শনিবার করে পালিত হয় বিপত্তারিণী চণ্ডীর ব্রত। দেবী দুর্গার ১০৮ রূপের মধ্যে অন্যতম দেবী সঙ্কটনাশিনীর এক রূপ, দেবী বিপত্তারিণী। যে কোনও মাতৃ-মন্দিরে দেবীর আরাধনা হয়। বাঙালি গৃহস্থ বাড়ির সধবা মহিলারা এই ব্রত করেন। ব্রতর আচার হিসেবে সব কিছু দিতে হয় তেরোটি করে। তেরোটি ফুল, তেরো রকম ফল, তেরোটি পান-সুপুরি। তেরো গাছা লাল সুতো, তেরোটি দূর্বা সমেত তেরোটি গিঁট বেঁধে তৈরি হয় পবিত্র ধাগা। আমের পল্লব সহযোগে প্রতিষ্ঠিত ঘটে নাম-গোত্র সহযোগে সংকল্প করেন মহিলারা। পুজোর মন্ত্র হিসেবে উচ্চারিত হয়,
মাসি পূণ্যতমেবিপ্রমাধবে মাধবপ্রিয়ে। ন বম্যাং শুক্লপক্ষে চবাসরে মঙ্গল শুভে। সর্পঋক্ষে চ মধ্যাহ্নেজানকী জনকালয়ে। আবির্ভূতা স্বয়ং দেবীযোগেষু শোভনেষুচ।
নমঃ সর্ব মঙ্গল্যেশিবে সর্বার্থসাধিকে শরণ্যে ত্রম্বক্যে গৌরী নারায়ণী নমস্তুতে।।
আরও শুনুনঃ Spiritual: শাস্ত্রমতে কখন সত্যের থেকে মিথ্যে হয়ে ওঠে শ্রেয়?
পুজোশেষে পাঠ হয় বিপত্তারিণী ব্রতকথা। এইদিন বিধান রয়েছে নিরামিষ খাবার গ্রহণের। চাল জাতীয় কোনও খাবার যেমন ভাত, চিড়ে, মুড়ি খাওয়া একেবারেই বারণ। যিনি ব্রত করেছেন তাঁর সঙ্গে বাড়ির অন্যেরাও নিরামিষ এবং চাল জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলেন খুব ভালো হয়। এইদিন সেই কারণেই নিরামিষ তরকারি, ডাল, আলুর দম-ইত্যাদির সঙ্গে লুচি বা পরোটা খাওয়ার চল রয়েছে।
মায়েরা প্রসাদ হিসেবে খান, তেরোটি লুচি বা পরটা সঙ্গে তেরো রকমের ফল। দেবী বিগ্রহের কাছে অর্পিত লাল ধাগাটি পরিবারের মঙ্গল কামনায়, হাতের তাগায় বাঁধা হয় হাতের তাগায়। বাঁধা হয়, ছেলেদের ডান হাতে আর মেয়েদের বাম হাতে।
এই ব্রত অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করলে পরিবার এবং সংসার বিপদ থেকে মুক্ত থাকে। আষাঢ় মাসের শুক্ল দ্বিতীয়া থেকে দ্বাদশী পর্যন্ত হয় এই পুজো। বাংলা এবং উড়িষ্যায় এই পুজোর চল সর্বাধিক প্রচলিত। কমপক্ষে অন্তত তিনটি ব্রত পালন করা এয়োস্ত্রী মহিলাদের অবশ্য কর্তব্য বলে হিন্দু শাস্ত্রে উল্লেখ রয়েছে।
বাংলা-উড়িষ্যায় এই ব্রত ব্যাপক ভাবে চালু হওয়ার নেপথ্যে কি পৌরাণিক বা ঐতিহাসিক কোনও গল্পগাথা আছে!
রথযাত্রার দিন রীতি অনুসারে হয় দেবী দুর্গার কাঠামো পূজা। দেবী বিপত্তারিণী তো আদতে দেবী দুর্গার রূপ। ফলে এই পূজার মাধ্যমে তাঁকে আবাহন করা হয়। গায়ের রং লাল। শঙ্খ-চক্র-শুল ও অসি হাতে তিনি ত্রিনয়না। আবার কোথাও তিনি ঘোর কৃষ্ণবর্ণা লোলজিহ্বা রূপে বাঘের ওপর আসীন। হাতে কাতান, ত্রিশূল এবং বরাভয়। দেবী স্বর্ণশোভিত।
দেবী চণ্ডী দানবদলনী, অসুর-নাশনী। স্বর্গ-মর্ত্য নির্বিশেষে সমগ্র তিনিই সমস্ত সৃষ্টির দুর্গতিনাশ করে শান্তির আশিস প্রদান করেন। বৈদিক যুগ থেকেই প্রচলিত ছিল গৌরীর পূজা। সেই ঐতিহ্য মেনেই মহাভারত যুদ্ধের পূর্বে পাণ্ডবদের বিপদ নাশের জন্য দ্রৌপদি আরাধনা করেছিলেন গৌরীর। পাণ্ডবদের রক্ষা এবং মঙ্গলকামনায় তিনি তাঁদের হাতে বেঁধে দিয়েছিলেন, তেরোটি গিঁট দেওয়া লাল ধাগা।
আরও শুনুনঃ Spiritual: জীবনে দুঃখ থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?
আরও একটি কাহিনির উল্লেখ মেলে। সেটির সঙ্গে বঙ্গের বিপত্তারিণী যোগ অনেক বেশি।
বাংলার বিষ্ণুপুরে সপ্তম থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত শাসন করেছিলেন মল্ল রাজারা। সেই বংশের এক রানি ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ। তাঁর নিম্নবর্গীয় এক হিন্দু মহিলার সঙ্গে নিবিড় বন্ধুত্ব ছিল। রানী শুনেছিলেন, এরা যাতে মুচি। এরা এমন মাংস ভক্ষণ করে, যা সচরাচর তাঁরা খান না। একদিন তাঁর সখীকে বললেন, ‘একদিন তুমি একটু ওই মাংস রেঁধে আমাকে দিয়ে যাবে, আমি দেখব!’ রানীর এই প্রস্তাব শুনে সেই মুচিনী তো ভয়ে আধমরা। একেই সে নিচু জাতের রমণী। রানির সঙ্গে বন্ধুত্ব তার পরম পাওয়া। রাজ অন্তঃপুরে যদি সেই মাংস ঢোকে, আর এই কথা যদি ধর্মাচারী রাজার কানে যায়! তাহলে! শাস্তিস্বরূপ তার গর্দান যাবে অথবা রাজ্য থেকে বিতাড়িত হতে হবে। সেকথা সে রানীকে খুব করে বোঝাল। রানি একেবারেই নাছোড়বান্দা, তিনি তো চেখে দেখবেন না, খালি চোখে দেখবেন, এতে আর কীই বা দোষ হবে! রানির প্রবল জোরাজুরিতে খানিক ভরসা পেয়ে মুচিনী একদিন কথামতো মাংস রান্না করে সন্তর্পণে দিয়ে গেল রানিকে। কোনও কর্মী মারফত এই খবর পৌঁছয় রাজার কানে। অন্তঃপুরে সেই বিশেষ মাংস প্রবেশ করেছে। এই কথা শুনে রাজা তো অগ্নিশর্মা। উপস্থিত হলেন রানির কাছে। অন্দরমহলে পৌঁছে হুঙ্কার ছাড়লেন। বললেন, ‘কী নিষিদ্ধ বস্তু লুকিয়ে এনেছ! দেখাও আমাকে।’ রানি বুঝলেন সব হিসেব গোলমাল হয়ে গিয়েছে। তাঁর অতিরিক্ত কৌতূহল কাল হয়েছে। তিনি তাড়াতাড়ি রান্না করা মাংস আঁচলের তলায় লুকিয়ে দেবী দুর্গাকে এই বিপদ থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য আকুল-প্রার্থনা করতে লাগলেন। রাজা অনেকক্ষণ খুব জোরাজুরি করলেন কিন্তু রানি কিছুতেই আঁচলের তলায় কি আছে দেখাবেন না। রাজা ক্রোধে আগুন হয়ে, তাঁর আঁচল ধরে দিলেন হ্যাঁচকা টান। কী আশ্চর্য! সেখান থেকে তখন ঝরে পড়ল, রক্তজবা ফুল। অনুতপ্ত রাজা রানীর কাছে ক্ষমা চাইলেন। ভক্তপ্রাণা দেবী তখন আবির্ভূতা হয়ে রানিকে জানালেন, ‘আমি তোমাকে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করেছি, এখন থেকে বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য, ভক্তিভরে আমার পূজা অর্চনা করো, আমিই তোমাদের সংসারের যাবতীয় বিপদ বাধা থেকে রক্ষা করব।’ সেই থেকেই মল্ল রাজাদের শাসনাধীন জনপদগুলোতে ক্রমেই ছড়িয়ে পড়তে লাগল, বিপত্তারিণী মাহাত্ম্য। চালু হল, খুব নিষ্ঠা সহকারে তাঁর পূজা।
এইভাবেই বঙ্গ-কলিঙ্গের ঘরে ঘরে এয়োস্ত্রীদের যাবতীয় বিপদ-আপদ থেকে মুক্তির জন্য সহায় হয়ে আছেন দেবী বিপত্তারিণী চণ্ডী। তিনি ভক্তদের বিঘ্ননাশনে সদা জাগ্রত। তাঁকে নিষ্ঠা ভরে স্মরণ করলে ভক্তের বিপদ বাঁধা দূর হয়, পূর্ণ হয় মনোবাঞ্ছা।