শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে বলা রয়েছে- “যদাহতমস্তন্ন দিবা ন রাত্রির্নসন্ন চাসচ্ছিব এব কেবলঃ।”
অর্থাৎ যখন আলো ছিল না, অন্ধকারও ছিল না; দিন ছিল না, রাত্রিও ছিল না; সৎ ছিল না, অসৎ ও ছিল না- তখন কেবলমাত্র ভগবান শিবই ছিলেন। শিবের ক্ষেত্রে বলা হয় “শিব এব কেবলঃ”। সৃষ্টির পূর্বে একমাত্র শিবই বর্তমান ছিলেন। এখনও সেই তত্ত্বের প্রমাণ মেলে দেশের বিখ্যাত কিছু শিব মন্দিরে পা রাখলে। কী বিশেষত্ব এইসব মন্দিরের? আসুন শুনে নিই।
শিবই সত্য। শিবই সুন্দর। অল্পেতেই তিনি তুষ্ট। জীবনের আসল সত্য বুঝতে গেলে শিবসাধনার পরামর্শ দেন সাধকরা। শিব শব্দের অপর একটি অর্থ হল যাঁর মধ্যে প্রলয়ের পর বিশ্ব নিদ্রিত থাকে। লিঙ্গ শব্দটির অর্থও একই – বিশ্বধ্বংসের পর যেখানে সকল সৃষ্ট বস্তু বিলীন হয়ে যায়। হিন্দুধর্মে, জগতের সৃষ্টি, রক্ষা ও ধ্বংস একই ঈশ্বরের দ্বারা সম্পন্ন হয়, সেই হেতু শিবলিঙ্গ স্বয়ং ঈশ্বরের প্রতীক রূপে পরিগণিত হয়।
এইসব প্রসঙ্গ স্রেফ তত্ত্বকথা নয়। দেশের এমন কিছু শিবমন্দির রয়েছে জীবনে একবার হলেও যেখানে যাওয়া উচিত। মনের শান্তি আত্মার আরাম, এইসব মন্দিরে গেলে একত্রে দুই অভিজ্ঞতা লাভ সম্ভব। ধর্মাচারের উর্ধ্বে সেখানে প্রকট হয়ে ওঠে দেবত্বের অনুভূতি। দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের কথা এক্ষেত্রে না বললেই নয়। তবে এর বাইরেও এমন কিছু শিবমন্দির রয়েছে যেখানে স্বয়ং ঈশ্বরকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব। প্রথমেই বলতে হয় বারানসীর কালভৈরব মন্দিরের কথা। এখানে দেবমূর্তিকে মদ দিয়ে পুজো দেওয়ার চল রয়েছে। মন্দিরের ভিতরকার পরিবেশ অন্যান্য শিবমন্দিরের তুলনায় বেশ খানিকটা আলাদা। সবসময় হোমাগ্নি প্রজ্জ্বলিত। যেকোনও অপশক্তিকে নিমেষে দূর করে দেয় সেই উষ্ণ আতাস। প্রতিদিন ভিড়ও হয় চোখে পড়ার মতো। দেশ বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভক্তরা এই মন্দিরে পুজো দিতে আসেন। কথিত আছে বারানসীর অধিশ্বর বাবা বিশ্বেশ্বরের দর্শণ অসম্পূর্ণ থেকে যায় এই মন্দিরে পুজো না দিলে। এরপর বলতে হয়, কৈলাস মন্দিরের কথা। পাহাড়ের গায়ে তৈরি এই মন্দিরটিকে অসাধারণ স্থাপত্যের নিদর্শনও বলা চলে। এই মন্দিরের গায়ে অসংখ্য সংস্কৃত মন্ত্র খোদাই করা রয়েছে। তালিকায় এরপরেই রয়েছে ভুবনেশ্বরের লিঙ্গরাজ মন্দির। ভূভারতে এই শিবলিঙ্গ সবথেকে বৃহৎ হিসেবে মনা করা হয়। প্রায় ৫৪ মিটার দৈর্ঘ্যের এই শিবলিঙ্গ নাকি নিজে থেকেই গর্ভগৃহে স্থাপিত হয়েছিল। এমনটাই বিশ্বাস স্থানীয়দের। প্রতিবছর মহাদেবের এই বিশেষ লিঙ্গরূপ দর্শণ করতে দূরদূরান্ত থেকে ভক্তরা ছুটে আসেন। এরপর রয়েছে স্তম্ভেশ্বর। এই মন্দিরের উপাস্য সারাবছর জলের নীচে থাকেন। বছরের বিশেষ সময় ভক্তদের দর্শন দেন প্রভু। নানা লোকশ্রুতি প্রচলিত রয়েছে এই মন্দিরটি ঘিরেও। তালিকার শেষ মন্দিরটি তামিলনাড়ুর মীনাক্ষী মন্দির। দেশের মধ্যে এখানেই কেবলমাত্র শিবের সহাস্য মূর্তি লক্ষ করা যায়। বছরের বিভিন্ন সময় এই মন্দিরে উৎসব হয়। সবসময় ভক্তদের ভিড় থাকে এই মন্দিরে।
শাস্ত্রে বলে, যে কোনও শিবলিঙ্গ সে মানুষের দ্বারা স্থাপিত হোক অথবা অথবা স্বয়ম্ভূ শিবলিঙ্গ হোক সঠিক উপাচারে পূজা করলে মানুষের মুক্তিলাভ হয়। শিবলিঙ্গের দর্শন এবং ভক্তিভরে নমস্কার জানালে মানুষের অসীম কল্যাণ হয়। শিবলিঙ্গ সর্বতীর্থময়। সকল তীর্থদর্শন, পূজা, দান করেও যে ফল লাভ হয় একবার মাত্র শিবলিঙ্গকে প্রণাম করলে তার থেকে বহুগুণ বেশি ফল লাভ হয়ে থাকে। আর সে প্রসঙ্গে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে দেশের এই শিবমন্দিরগুলি। শৈবসাধকরা তো বটেই, সাধারণ দর্শনার্থীরাও জীবনে অন্তত একবার এই শিবমন্দির দর্শন করলে বিশেষ পুন্যের ভাগীদার হন।