মহাবিদ্যার অংশ হলেও দেবী কালীকে নিজের কন্যারূপেই দেখেছেন বহু সাধক। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে ওঠা কালীমন্দিরগুলি ঘিরেও প্রচলিত হয়েছে নানান কিংবদন্তি। যার কোনোটিই সাধারণের মনে ভয়ের উদ্রেক করে না। কিন্তু এই দেবীর কিছু রূপান্তর এমনও রয়েছে যা একেবারেই গৃহস্থের পূজনীয় নয়। তন্ত্রসাধনায় পারদর্শী সাধক ছাড়া দেবীর সেই বিশেষ রূপগুলির পুজো করার অধিকারও নেই অন্য কারও। দেবী কালীর বিভিন্ন রূপের কথা লিখলেন শুভদীপ রায়।
শয়নরত মহেশ্বরের বুকের উপর পা দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন চতুর্ভূজা দেবী। ঘোর কৃষ্ণবর্ণ এই দেবীমূর্তি লোলজিহ্বা। সাধারণত দেবী কালীর এমন মূর্তিই দেশের নানা প্রান্তে পূজিত হয়ে থাকে। দীপান্বিতা অমাবস্যার দিনেও দেবীর এই রূপটিকেই ভক্তিভরে পুজো করা হয়। মায়ের ভক্ত হিসাবে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে কালীপুজোয় একত্রিত হন সাধারণ মানুষ। কিন্তু এই বিশেষ রূপটি ছাড়াও দেবী কালীর আরও কিছু রূপ আছে যা একেবারেই সর্বসাধারণের পুজো করার জন্য নয়।
আরও শুনুন: শ্রীচৈতন্যদেবের জন্মস্থানেই তন্ত্রসাধক কৃষ্ণানন্দ রূপ দিয়েছিলেন বাংলার প্রথম কালী বিগ্রহের
বিভিন্ন পুরাণ অনুসারে কালীর অনেকগুলি রূপভেদের কথা জানা যায়। এর মধ্যে প্রথমেই বলতে হয় কালীর সবথেকে প্রচলিত রূপ তথা দক্ষিণা-কালীর কথা। বাংলায় তিনি শ্যামাকালী নামেও পরিচিত। দেবীর ডান পা সামনের দিকে অবস্থান করে বলে এঁকে দক্ষিণা-কালী বলা হয়। ধ্যানমন্ত্র অনুসারে তিনি করালবদনা, ঘোরা, মুক্তকেশী, চতুর্ভূজা এবং মুণ্ডমালাবিভূষিতা। তাঁর বামকরযুগলে স্থান পায় সদ্যছিন্ন নরমুণ্ড ও খড়্গ। আর দক্ষিণকরযুলে দেবী বর ও অভয় মুদ্রা প্রদান করেন। দিগম্বরী এই দেবীর গাত্রবর্ণ মূলত কালো। কিন্তু কোথাও আবার শ্যামাকালীর গায়ের রং নীলও দেখা যায়। দেশের বিভিন্ন প্রসিদ্ধ কালীমন্দিরগুলিতে দেবী এই রূপেই পূজিতা।
এরপর কালীর যে রূপটির বিশেষ ভাবে সকলের পরিচিত তা হল, শ্মশান-কালী। শোনা যায় দেবীর এই রূপের প্রধান সাধক ছিল ডাকাত দলগুলি। তাই অনেকেই দেবীর এই রূপকে ‘ডাকাত-কালী’ বলে থাকেন। আবার কালীর এই রূপটির পূজা সাধারণত শ্মশানঘাটে হয়ে থাকে। তাই এই দেবীকে শ্মশানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হিসেবেই মনে করা হয়। তন্ত্রের কিছু গোপন সাধনার ক্ষেত্রে এই দেবীকেই কল্পনা করে থাকেন তান্ত্রিকরা। শোনা যায়, সেকালের ডাকাতেরা ডাকাতি করতে যাবার আগে শ্মশানঘাটে নরবলি দিয়ে শ্মশানকালীর পূজা করতেন। তাই গৃহস্থবাড়িতে বা পাড়ায় সর্বজনীনভাবে শ্মশানকালীর পুজো করা নিষিদ্ধ।
এর পর বলতে হয় কালীর এক অপ্রচলিত রূপ তথা, সিদ্ধ-কালীর কথা। যা গৃহস্থের জন্য একেবারেই নিষিদ্ধ। দেবীর এই রূপ মূলত সিদ্ধ সাধকদের প্রধান আরাধ্যা। কালীতন্ত্র-এ তাঁকে দ্বিভূজা রূপে কল্পনা করা হয়। মূর্তিতে সাধারণ কালীর রূপের থেকেও বেশ কিছু বৈসাদৃশ্য দেখা যায়। দেবীর এক হাতে রাখা থাকে ‘কপালপাত্র’। এখানেও দেবী শিবের উপর অধিষ্ঠাত্রী। তাঁর বাম পদ শিবের বুকে ও দক্ষিণ পদ শিবের ঊরুদ্বয়ের মধ্যস্থলে থাকে। এবং দেবীর পূজার প্রধান উপকরণ হিসেবে থাকে মদ ও মাংস।
কালীর এরপরের যে রূপটির কথা শুনব, তাও সাধারণের জন্য গুপ্ত। নাগাসনে উপবিষ্টা এই দেবী হলেন গুহ্যকালী। দেবীর সারা শরীরেই বিভিন্ন ভঙ্গিতে নাগের অবস্থান দেখা যায়। অদ্ভুতভাবে এখানে মহাদেবের অবস্থান দেবীর বাম পাশে। এই দেবীর গায়ের রংও গাঢ় কৃষ্ণবর্ণ। গলায় ৫০টি নরমুণ্ডের হার এবং কানে শবদেহের আদলের অলঙ্কার দেখা যায়। সারা বাংলায় কেবলমাত্র মুর্শিদাবাদ-বীরভূম সীমান্তবর্তী আকালীপুর গ্রামেই মহারাজা নন্দকুমার প্রতিষ্ঠিত একমাত্র গুহ্যকালীর মন্দির রয়েছে। মহাকাল সংহিতা মতে, নববিধা কালীর মধ্যে গুহ্যকালীই হলেন সর্বপ্রধানা।
এরপর রয়েছেন ভদ্রকালী। যিনি মরণকালে জীবের মঙ্গলবিধান করেন, তিনিই ভদ্রকালী। কালীর অন্যান্য রূপগুলির মতো এই রূপ ততটা ভয়ঙ্কর নয়। কালিকাপুরাণ মতে, ভদ্রকালীর গাত্রবর্ণ অতসীপুষ্পের ন্যায়, দেবীর মাথায় জটা, এবং ললাটে অর্ধচন্দ্র অবস্থিত। তন্ত্রমতে অবশ্য তিনি মসীর ন্যায় কৃষ্ণবর্ণা, কোটরাক্ষী, সর্বদা ক্ষুধিতা, মুক্তকেশী। তাঁর হাতে থাকে জ্বলন্ত অগ্নিশিখা ও পাশযুগ্ম। গ্রামবাংলায় অনেক জায়গায় ভদ্রকালীর বিগ্রহ নিষ্ঠাসহকারে পূজিত হয়।
আরও শুনুন: কেরানি থেকে হলেন সাধক কবি, মা কালী কি সত্যিই কৃপা করেছিলেন রামপ্রসাদ সেনকে?
এছাড়াও কালীর অন্যান্য রূপ হিসেবে রয়েছে চামুণ্ডাকালী, মহাকালী ও শ্রীকালীর কথা। সেখানে কোথাও অস্ত্র হিসেবে দেখা যায় ত্রিশূল আবার কোথাও দেখা যায় দেবীর অস্থিচর্মসার শরীর ও বিকট দাঁত। আবার কোথাও দেবী কালীর রূপও দশভূজা হিসেবে পূজিতা হন। প্রত্যেক ক্ষেত্রেও কোনও বিশেষ অসুরকে বধ করার জন্য জন্ম হয়েছে দেবীর এইসব রূপ। তাই সাধারণ মানুষও নিজেদের শত্রু বিনাশের আশা নিয়েই দেবী কালীর আরাধনায় মেতে ওঠেন।