শক্তি-আরাধানার সঙ্গেই ওতপ্রোত জড়িত বলিপ্রথা। এককালে নাকি চল ছিল নরবলির। পরে তা গিয়ে ঠেকে পশুবলিতে। রুধিরধারায় মাকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করেন সাধকরা। শাস্ত্রেও এর ইঙ্গিত মেলে। ফলত স্বামীজি যখন শক্তি-আরাধনা শুরু করবেন মনস্থ করেছিলেন, তখন বলির কথাও ভাবছিলেন। কিন্তু সে প্রস্তাব খারিজ হয়ে গেল ‘হাই কোর্টের’ রায়ে। কে এই ‘হাই কোর্ট’ জানেন? শুনে নিই।
বেলুড় মঠে দুর্গাপুজো করবেন বলে মনস্থ করেছেন স্বামীজি। সে-কারণে দিন চার পাঁচেকের মধ্যেই রঘুনন্দনের অষ্টাবিংশতি-তত্ত্ব পড়ে শেষ করে ফেলেছেন। ‘স্মৃতি’-তে আছে বলির ইঙ্গিতও। স্বামীজির ইচ্ছা, মায়ের ইচ্ছা হলে তা-ও নাহয় করা যাবে। কিন্তু তিনি ভাবলেই তো হবে না। রামকৃষ্ণ সংঘের কোনও কাজই যে একজনের অনুমতি ছাড়া চলে না। তিনি মা সারদা। সংঘনেত্রী সারদাকে তাঁর সন্তানেরা ‘হাই কোর্ট’-ও বলতেন। অর্থাৎ তাঁর কথাই শিরোধার্য।
আরও শুনুন: মা কালীর বিশেষ কয়েকটি রূপের পুজো করেন না গৃহস্থরা, নেপথ্যে শাস্ত্রের কোন কারণ?
এই নামকরণের নেপথ্যে অবশ্য একখানা গল্প আছে। একসময় মঠের তত্ত্বাবধানে ছিলেন স্বামী শিবানন্দজি। সে সময় ব্রহ্মচারী ছোট নগেন কোনও একটা ভুল কাজ করে ফেলেন। সে কারণে তাঁকে বলা হয় যে, মহাপুরুষ মহারাজ তাঁকে মঠ থেকে বের করে দেবেন। ব্রহ্মচারী কাউকে কিছু না বলে সোজা মা সারদার কাছে হাজির হন। কিছুদিন পরেই শিবানন্দজি মায়ের থেকে একটা চিঠি পেলেন। সে-চিঠিতে অনুরোধ যে, মহারাজ যেন ব্রহ্মচারীকে বিশেষ বকাবকি না করেন। শিবানন্দজিও পালটা ডাকে চিঠি দিয়ে তাঁকে আশ্বস্ত করলেন। কিছুদিন পরে ব্রহ্মচারী মঠে ফিরে আসতেই, শিবানন্দজি তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, ব্যাটা আমার নামে হাই কোর্টে নালিশ করতে গিয়েছিলি! এই হাই কোর্ট আর কেউ নন, স্বয়ং সংঘজননী সারদা। যাঁর অনুমতি ছাড়া কোনও কাজই করতেন সন্ন্যাসীরা।
স্বামীজিও বলির ব্যাপারে তাই মায়েরই শরণাপন্ন হলেন। সব শুনে মা জানালেন, ‘হ্যাঁ বাবা, মঠে দুর্গাপুজো করে শক্তির আরাধনা করবে বইকি। শক্তির আরাধনা না করলে কি কোনও কাজ সিদ্ধ হয়? তবে বাবা, বলি দিও না। প্রাণী হত্যা কোরো না। তোমরা হলে সন্ন্যাসী, সর্বভূতে অভয়দানই তোমাদের ব্রত।’
আরও শুনুন: শ্রীচৈতন্যদেবের জন্মস্থানেই তন্ত্রসাধক কৃষ্ণানন্দ রূপ দিয়েছিলেন বাংলার প্রথম কালী বিগ্রহের
মায়ের কথাই শিরোধার্য করেছিলেন স্বামীজি। বলি থেকে সরে এসেছিলেন। সেই রীতি আজও মান্য করা হয় মঠে। শক্তি আরাধনার এই মুহূর্তে আমরা তাই স্মরণ করি জগজ্জননী সারদার সেই কথাটিকে। সর্বভূতে অভয়প্রদানই মানবের ধর্ম। তাই শক্তি আরাধনায় রত হলেই যে বলি দিতে হবে, তার কোনও মানে নেই। অনেকে আবার অন্তরের পশুত্ব এবং রিপুদমনকেই বলি হিসাবে চিহ্নিত করেছেন।