সম্প্রদায় আলাদা হয়। তাঁদের আচার অনুষ্ঠানও হয় ভিন্ন। কিন্তু পথ যেরকমই হোক না, প্রকৃত সত্য কিন্তু আলাদা নয়। যে যেপথেই সাধন করুন না কেন, সকলে একই বিন্দুতে পৌঁছাতে চান। সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে, নানা মতের ভেদ তাই বাহ্যিক। এ কথাই যুগে যুগে বলে এসেছেন মহাপুরুষগণ। এই প্রসঙ্গেই আমরা শুনে নিই মহাত্মা কবীরের কথা।
মানুষে মানুষে মিলনের জন্য অবিরাম চেষ্টা করেছেন সন্তগণ। এদিকে সম্প্রদায়গত ভেদ মানুষকে ক্রমাগত আলাদা করে রেখেছে। আচার, অনুষ্ঠানের বিভিন্নতা তাঁদের শিখিয়েছে, তারা একে অন্যের থেকে আলাদা। সেই নিয়েই লাঠালাঠি, ঠোকাঠুকি লেগে যায়। আর যাঁরা মহাপুরুষ, যাঁরা সন্ত, তাঁরা এই ভেদটুকুই মুছে দিতে চান। বলেন, এই বাহ্যিক ভেদ সত্য নয়। তার জন্য অবশ্য তাঁদের কম কষ্ট সহ্য করতে হয়নি। এমনকী দাঁড়াতে হয়েছে অভিযোগের কাঠগড়াতেও।
আরও শুনুন: Spiritual: ‘লোহার তরোয়াল সোনার হলে আর কারও অনিষ্ট করে না’
সন্ত কবীরের জীবনে একবার এরকমই একটি ঘটনা ঘটেছিল বলে শোনা যায়। কাশীতে হিন্দু ও মুসলমান সাধনার মিলন সম্বন্ধে নিরন্তর চেষ্টা করছিলেন কবীর। কিন্তু তাঁর কাজ খুশি করতে পারল না পণ্ডিতদের। তাঁরা বাদশাহের কাছে গিয়ে নালিশ করলেন। বললেন, এই ব্যক্তি মুসলমান হয়ে আমাদের ধর্মে হস্তক্ষেপ করছেন। বাদশা যেন এর বিচার করেন। এদিকে একই নালিশ গিয়ে পড়ল মুসলমান ধর্মগুরুদের দিক থেকেও। তাঁরাও বললেন, মুসলমান কুলে জন্ম হলেও এই ব্যক্তি রাম-হরি নিয়ে পড়ে আছেন। যা মুসলমান ধর্মের পক্ষে অপমানজনক। দুই পক্ষের নালিশ জমতে, এবার বাদশাহের দরবারে ডাক পড়ল কবীরের। তলব শুনে তিনি নিজে গেলেন সেখানে। আর গিয়েই সশব্দে হেসে উঠলেন সন্ত। সভার বাকিরা তো কবীরকে হাসতে দেখে স্তম্ভিত। যিনি অভিযুক্তের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে, তিনি এভাবে হাসছেন কেন? সে কথা জিজ্ঞেস করা হল কবীরকে। কবীর শুনে হাসতে হাসতেই বললেন, ঠিক এই জিনিসটাই তো আমি চেয়েছিলাম। শুধু ঠিকানা একটু আলাদা হয়ে গিয়েছে, এই যা। তারপর তাঁর বক্তব্য ভেঙে বললেন কবীর। বললেন, আমি তো চেয়েছিলাম হিন্দু-মুসলমানের মিলন হোক। সবাই বলেছিল, তা হতে পারে না, তা অসম্ভব। কিন্তু এখন তো দেখা যাচ্ছে মিলন হয়েছে। কবীর বললেন, চেয়েছিলাম, জগদীশ্বরের সিংহাসনের তলে এই মিলন হোক। হয়েছে বাদশাহের সিংহাসনের সামনে।
আরও শুনুন: ব্রহ্মচারী বলেন ‘এগিয়ে যাও’… এগোলে কী মেলে?
এরপর কবীর শোনালেন আরও আশার কথা। বললেন, এখানে যদি মিলন সম্ভব হয়, তবে ঈশ্বরের আসনতলেও এই মিলন সম্ভব। কেননা এখানে সকলে মিলিত হয়েছেন বিদ্বেষের ইন্ধনে। আর ঈশ্বরের আসনের নীচে তো অপূর্ব প্রেমের লীলা। প্রেম মানুষকে উদার করে। তার মনের আকাশকে উদাত্ত করে। এখানে যদি এঁরা মিলতে পারেন, প্রেম ও মৈত্রীর সূত্রেই বা এঁরা মিলবেন না কেন? কবীর বললেন, যে মিলনের স্বপ্ন দেখেছিলাম, সেই মিলন আজ বাস্তবায়িত হয়েছে দেখেই হাসি থামাতে পারছি না। এই বলে কবীর তাঁর হাসির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেন।
এই কাহিনির ঐতিহাসিক সত্যতা যাই হোক না কেন, এর অন্তরের সত্যটি আজও আমাদের আলোর দিশা দেখায়। তা বলে, বিদ্বেষ অতিক্রম করে প্রেম আর মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হতে। সম্প্রদায়গত ভেদের খোলসটি ছেড়ে বেরোতে পারলেই, মানুষে মানুষে এই মহামিলন সম্ভব।